লিভার যে কারণে নষ্ট হয় বা পঁচে যায়, জেনে নিন

মানুষের দেহের প্রধান অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোর মধ্যে অন্যতম হল লিভার। দেহের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনায় লিভারের সুস্থতা অনেক জরুরী। কিন্তু কিছু বাজে অভ্যাসের কারণে প্রতিনিয়ত মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে লিভার। এরই ফলাফল হিসেবে লিভার ড্যামেজের মতো মারাত্মক সমস্যায় ভুগতে দেখা যায় অনেককেই। এই অঙ্গটি নষ্ট হওয়ার পিছনে কারণগুলি দেখে নেওয়া যাক৷
১) দেরি করে ঘুমোতে যাওয়া এবং দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা দুটোই লিভার নষ্টের কারণ। এতে শারীরিক সাইকেলের সম্পূর্ণ উল্টোটা ঘটতে থাকেএবং তার মারাত্মক বাজে প্রভাব পরে লিভারের উপরে।
২) অনেকেই সকালে ঘুম থেকে উঠেও কুড়েমি করে প্রস্রাবের বেগ হলেও বাথরুমে না গিয়ে তা চেপে শুয়েই থাকেন। এতে লিভারের উপরে চাপ পড়ে এবং লিভার স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারায়।
৩) অতিরিক্ত বেশি খাওয়াদাওয়া করা লিভারের পক্ষে ক্ষতিকর । অনেকেই আবাব বহুক্ষণ সময় না খেয়ে একবারে অনেক বেশি বেশি করে খেয়ে ফেলেন। এতে হঠাৎ করে লিভারের উপরে চাপ বেশি পরে এবং লিভার ড্যামেজ হওয়ার আশংকা থাকে।
৪) সকালের খাবার না খাওয়ায় লিভার পক্ষে ক্ষতিকর। যেহেতু অনেকটা সময় পেট খালি থাকার কারণে অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের পাশাপাশি খাদ্যের অভাবে কর্মক্ষমতা হারাতে থাকে লিভারও।
৫) অনেক বেশি ঔষধ খেলে লিভার নষ্ট হয়৷ বিশেষ করে ব্যথানাশক ঔষধের জেরে লিভারের কর্মক্ষমতার হ্রাস পায়ে। এছাড়াও ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ক্ষতি হয় লিভারের। এতে করে লিভার ড্যামেজ হয়ে যাওয়ার আশংকা দেখা দেয়।
৬) কেমিক্যাল সমৃদ্ধ যেকোনো কিছুই লিভারের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। কিন্তু আলসেমি ও মুখের স্বাদের জন্য আমরা অনেকেই প্রিজারভেটিভ খাবার, আর্টিফিশিয়াল ফুড কালার, আর্টিফিশিয়াল চিনি ইত্যাদি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলি যা লিভার নষ্টের অন্যতম কারণ।
৭) খারাপ তেল ও অতিরিক্ত তৈলাক্ত খাবার লিভারের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। একই তেলে বারবার ভাজা খাবার বা পোড়া তেলের খাবার বেশি পরিমাণে খাওয়া হলে লিভার তার স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারাতে থাকে।
৮) অতিরিক্ত কাঁচা খাবার খাওয়াও লিভারের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। যেমন আপনি যদি খুব বেশি কাঁচা ফলমূল বা সবজি খেতে থাকেন তাহলে তা হজমের জন্য অতিরিক্ত কাজ করতে হয় পরিপাকতন্ত্রের। এর প্রভাব পড়ে লিভারের উপরেও। সুতরাং অতিরিক্ত খাবেন না।
৯) অতিরিক্ত পরিমাণে মদ্য পান করা লিভার নষ্টের আরেকটি মূল কারণ। অ্যালকোহলের ক্ষতিকর উপাদান সমূহ লিভারের মারাত্মক ক্ষতির কারণ।

চিকুনগুনিয়া থেকে উপশম পাবেন যেভাবে

ডা. মোহাম্মদ আলী : চিকুনগুনিয়া নামক ভাইরাস জ্বরের ব্যাপক প্রকোপ দেখা যাচ্ছে শহর ও শহরতলীগুলোতে। ভাইরাসজনিত এ জ্বরটি প্রাণঘাতী না হলেও এ রোগে আক্রান্তরা তীব্র থেকে তীব্রতর অস্থিসন্ধি বা জয়েন্ট ব্যথায় ভুগে থাকেন। স্বাস্থ্য ভেঙ্গে যায় অনেকের।
সাধারণত এ জ্বর দুই থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে ভালো হয়ে গেলেও সন্ধির ব্যথা মাসব্যাপী রোগীকে কষ্ট দিতে থাকে। তাই ব্যথার কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে কিছু পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে-
* আক্রান্ত জয়েন্টে বরফ সেক দিলে তা খুব ভালো ফল দেয়। একটা তোয়ালে বা নরম কাপড়ে বরফকুচি নিয়ে ব্যথার স্থানে ৩ থেকে ৫ মিনিট ধরে রাখুন। এভাবে ১০-১৫ মিনিট বরফ সেক দেয়া যেতে পারে। এতে প্রদাহ কমে ব্যথা কমে আসবে। সরাসরি বরফ লাগাবেন না, এতে কোল্ড বার্ন হতে পারে।
* ব্যথার স্থানে তিলের তেল দিয়ে হালকা ম্যাসাজ করা যেতে পারে। ম্যাসাজের ফলে ওই স্থানের রক্ত চলাচল বেড়ে ব্যথা কমবে। তবে অধিকহারে ও দীর্ঘ সময় ম্যাসাজ করা থেকে বিরত থাকুন। ফলে জয়েন্টের টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
* অনেক চিকিৎসক এক গ্লাস দুধে আধা চা চামচ হলুদ গুঁড়া মিশিয়ে দিনে দু’বার খেতে বলেন। হলুদের প্রদাহবিরোধী উপাদান চিকুনগুনিয়াজনিত ব্যথা কমাতে সাহায্য করে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
* ফিজিওথেরাপি : যে কোনো প্রদাহজনিত ব্যথা নিরাময়ে ফিজিওথেরাপি ব্যথানাশক বা অন্য যে কোনো কিছুর চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর। ইলেক্ট্রোথেরাপি ও ওয়াক্সথেরাপি এ ধরনের ব্যথা কমাতে খুব কার্যকর। তবে চিকিৎসানির্ভর করবে রোগীর বর্তমান অবস্থার ওপর। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া জরুরি।
চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড় পরিষ্কার রাখুন। টবে ছাদে জলছাদে বা কোনো পাত্রে পানি জমতে দেবেন না। মশারি ব্যবহার করুণ। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।

লেখক : পেইন ও ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞ, এইচপিআরসি, উত্তরা, ঢাকা

কওমি মাদরাসা শিক্ষা : ইতিহাস ও অবদান

মুফতী সালাহুদ্দীন মাসউদ:
———————————–
ভারতবর্ষে নূরাণী ইলমের আগমন:

খোলাফায়ে রাশেদার যুগেই সাতজন সাহাবী ও আঠার জন তাবেয়ী ভারত উপমহাদেশে আগমন করে ইসলামি শিক্ষার বীজ বপন করেন। তবে সাহাবীগণ এখানে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেননি। তাবেয়ীদের আমল থেকে মুসলমানগণ উপমহাদেশে স্থায়ীভাবে বসতি আরম্ভ করেন।

হিজরি পঞ্চম শতকে সুলতান মাহমুদ গজনভীর পাঞ্জাব বিজয় এবং সুলতান মুহাম্মাদ ঘোরীর দিল্লী বিজয়ের পর গোটা উপমহাদেশে ইসলামি শিক্ষার বিস্তার ঘটে। খোলাফায়ে রাশেদার আমলেই সিন্ধু, পাঞ্জাব, লাহোরসহ সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে ইলমী চর্চা তুঙ্গে উঠে।
হিজরি ষষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি হযরত খাজা মঈন উদ্দীন চিশতী রহ. সহ বহু বুজুর্গানে দ্বীন আরব অঞ্চল থেকে উপমহাদেশে আগমন করার ফলে দ্বীনি শিক্ষার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। সে যুগে স্বতন্ত্রভাবে প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতিতে দ্বীনি তালীমের প্রচলন কম ছিল। মসজিদের মধ্যেই সাধারণত তালীমের কাজ চলত। তবে মুয়াল্লিম ও তালেবে ইলমদের থাকার জন্য মসজিদের চারদিকে কামরা নির্মাণ করে দেয়া হত। উপমহাদেশের বহু লোক আরব এলাকায় গমন করে দ্বীনি শিক্ষা লাভ করতেন এবং নিজ এলাকায় ফিরে এসে নিজের বাড়িতে বা মসজিদে অন্যদের শিক্ষা দিতেন। হিজরি ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষের দিকে মুসলিম শাসকদের সক্রিয় সহযোগিতায় বিভিন্ন স্থানে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দ্বীনি মাদরাসা গড়ে উঠে।
হিজরি সপ্তম শতকের গোড়ার দিকে সুলতান নাসির উদ্দীন মুলতানে সর্বপ্রথম একটি মাদরাসা কায়েম করেন। ঐতিহাসিক ফেরেশতা বলেন, এ শতকে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজি তৎকালীন বাংলার রংপুর জিলায় একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে মুহাম্মাদ তুঘলক ও ফিরোজ শাহ তুঘলকের আমল থেকে দ্বীনি ইলমের প্রতিষ্ঠান কায়েমের ব্যাপক উদ্যোগ শুরু হয়। আল্লামা মাকরেযীর বর্ণনা মতে, মুহাম্মাদ তুঘলকের আমলে কেবল দিল্লী শহরেই প্রায় একহাজার মাদরাসা গড়ে উঠে।

হিজরি অষ্টম শতক থেকে মুসলিম শাসকমন্ডলী প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দ্বীনি শিক্ষা বিস্তারের প্রতি গভীর মনযোগী হন। প্রতিষ্ঠান কায়েমের মাধ্যমে ইলমের বিকাশ সাধনে তারা বহুমূখী উদ্যোগ গ্রহণ করেন। গুজরাটের সুলতান মুহাম্মাদ আদিল শাহ আরবের সাথে সামুদ্রিক যোগাযোগ স্থাপন করলে উপমহাদেশীয় মুসলমানগণ আরব, মিশর ইত্যাদি দেশ থেকে ইলম শিক্ষা করে স্বদেশে ফিরে ইলম বিস্তার করতে থাকেন। আদিল শাহের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে গুজরাট দ্বীনি ইলমের অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়। প্রখ্যাত মুহাদ্দিস শায়খ আলী মুত্তাকী ও শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে তাহির পাটনী রহ. এই গুজরাটেই ইলম শিক্ষা দেন।

ভারতবর্ষে আহলে ইলমের বিপর্যয়
কালের আবর্তনে মুসলিম শাসকবর্গের পরিশুদ্ধ মন মানসিকতায় ক্রমান্বয়ে ধ্বস নামে। ঈমান, আমল ও দ্বীনদারী ধীরে ধীরে বিদায় নিয়ে বদদ্বীনি, বদ আখলাকী ও বিলাসীতার গড্ডালিকা প্রবাহ তাদেরকে গ্রাস করে ফেলে। ইলম ও হিদায়েতের নিয়ামত হাতছাড়া হয়ে যায়।

সম্রাট আকবরের মত ইলম ও হিকমত শূন্য বিরাণ মস্তিস্ক রাজক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। ইলমের অভাবে নিজেও গোমরাহ হয় অন্যকেও গোমরাহ করে। সব ধর্মের সংমিশ্রনে ‘দ্বীনে ইলাহী’ নামে এক উদ্ভট ধর্ম আবিস্কার করে। ধর্মের নামে তার এ অপআবিস্কারের প্রতি যুগের বালআম ইবনে বাউরাদের সমর্থন লাভেও সে ধন্য হয়। আল্লাহ তা’য়ালা এদের অপকীর্তি নস্যাৎ করে ইলম ও হিদায়াতকে হিফাজত করার জন্য মুজাদ্দিদে আলফেসানী রহ. এর মত মহাপুরুষগণকে আগে থেকেই প্রস্তুত করে রেখেছিলেন নইলে শক্তিমদমত্ত দুনিয়ার মোহে আক্রান্ত খোদাদ্রোহী শাসকদের হাতে ইলমের বিপর্যয় ঘটত।

যেই ইলম ও হিদায়েতের নিয়ামতের বদৌলতে আল্লাহ তা’য়ালা তেত্রিশ কোটি দেবতার রাজ্যে মুসলমানদের হাতে শাসন ক্ষমতা তুলে দিলেন সেই মহা নিয়ামতকে হেলায় ফেলায় ভোগ বিলাসীতায় হাতছাড়া করার কারণেই আল্লাহ তা’য়ালা রাজ ক্ষমতার লাগাম কেড়ে নিয়ে শত্রুর হাতে সোপর্দ করলেন। ইংরেজ বেনিয়াদেরকে সওদাগরের বেশে পাঠিয়ে দিলেন। ব্যবসার ছদ্মাবরণে তারা রাজক্ষমতা দখল করে নিল। মুসলিম রাজন্যবর্গের রাজ্য হারানোর সাথে সাথে তাদের ইলমের পৃষ্টপোষকতার অবসান ঘটে। ইলম আবার সেই পূর্বাবস্থায় ফুকারা ও গোরাবাদের তত্ত্বাবধানে ফিরে আসে। মুসলিম শাসকরা যেসব জায়গীর ও ওয়াক্ফ সম্পত্তির আয় দ্বারা দ্বীনি মাদারিস পরিচালনা করতেন ইংরেজরা সেসব বাজেয়াপ্ত করে হিন্দুদেরকে জমিদারী দিয়ে দেয়।

ক্ষমতা দখল করার পরই উপমহাদেশজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাজার হাজার মাদরাসাকে তারা অতি দ্রুত ধ্বংস করে ফেলে। দিল্লীর কেন্দ্রীয় মাদরাসাগুলিকে ঘোড়ার আস্তাবলে রুপান্তরিত করে। আলেম উলামাদেরকে বিভিন্ন অজুহাতে পাইকারীহারে হত্যা, জেল, জুলুম ও দেশান্তর করার মাধ্যমে এ ভু-খন্ড থেকে ইলমের নূর নিভিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে।
কাওমি মাদরাসার পূনঃপ্রতিষ্ঠা
এসব বহুমূখী ষড়যন্ত্রের ফলশ্রুতিতে দ্বীনি ইলম শিক্ষা সামগ্রিকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে মুসলিম সমাজ শিরক, বিদআত, রুসম-রেওয়াজ এমনকি বহু হিন্দুয়ানী প্রথার দ্বারা কলুষিত হয়ে উঠে। এরই প্রেক্ষাপটে তৎকালীন মুসলিম মনীষিবৃন্দ তথা হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ., মাওলানা রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহী রহ., মাওলানা কাসেম নানুতুবী রহ. প্রমূখ আলেমগণ নিভূপ্রায় ইলমে দ্বীনের নূরকে নতুনভাবে প্রজ্বলিত করার মানসে মদীনার মাদরাসায়ে সুফফার আদলে দেওবন্দের ছাত্তা মসজিদে আরেকটি বাতিঘর স্থাপন করেন।
প্রাথমিক পর্যায়ে দেওবন্দের এই বাতিঘরের নাম রাখা হয়- আরবি মাদরাসা। প্রথম বছর শুরুর দিকে প্রায় ২১ জন তালেবে ইলম ভর্তি হয়, বছরের শেষে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৮ জনে। দিন দিন ছাত্রসংখ্যা বাড়তে থাকায় ছাত্তা মসজিদ চত্বরে স্থান সংকুলান না হওয়াতে হিজরী ১২৯০ সালে মাদরাসাকে দেওবন্দের জামে মসজিদে স্থানান্তর করা হয়। ঐ বছরই হযরত নানুতাবি রহ. এর ইলহাম অনুযায়ী ছাত্তা মসজিদ সংলগ্ন খোলা মাঠে মাদরাসার নতুন ইমারত তৈরির জন্য এক প্রশস্ত জায়গা খরিদ করা হয় এবং তৎকালীন মুহতামিম শাহ রফিউদ্দিন রহ. এর স্বপ্নে নির্দেশিত স্থানে বর্তমানের মূল মাদরাসা ভবন তথা নৌদারার ভিত্তি স্থাপন করা হয়।
হিজরি ১২৯৬ সালে সদরুল মুদাররিসীন হযরত মাওলানা ইয়াকুব রহ. এর প্রস্তাবক্রমে দেওবন্দ আরবি মাদরাসাকে নতুনভাবে ‘দারুল উলূম দেওবন্দ’ নামকরণ করা হয়। দারুল উলূম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠালগ্নেই এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও সুশৃংখল পরিচালনার জন্য এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মহান শিক্ষা সাধক ও সংস্কারক, কাসেমূল উলূম ওয়াল খায়রাত হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ কাসেম নানুতাবী রহ. তাঁর পরিশুদ্ধ আত্মাশক্তি ও বিদগ্ধ চিন্তার আলোকে আটটি মূলনীতি প্রণয়ন করেন- যা ইলমের ইতিহাসে ‘উসূলে হাশত গানাহ’ বা মূলনীতি অষ্টক নামে পরিচিত।

মূলনীতিগুলো নিম্নরুপঃ
১। যথাসম্ভব মাদরাসার আসাতিযায়ে কিরাম ও মুলাযেমদের অধিক হারে চাঁদা আদায়ের বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। নিজেও এর জন্য চেষ্টা করবে। অন্যের মাধ্যমেও চেষ্টা করাবে। মাদরাসার হিতাকাঙ্ক্ষীদেরও এ বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।
২। যেভাবেই হোক মাদরাসার ছাত্রদের খানা চালু রাখতে হবে এবং ক্রমান্বয়ে তা বৃদ্ধি করার ব্যাপারে মাদরাসার হিতাকাঙ্ক্ষী ও কল্যাণকামীদের সর্বদা সচেষ্ট থাকতে হবে।
৩। মাদরাসার উপদেষ্টাগণকে মাদরাসার উন্নতি, অগ্রগতি এবং সুষ্ঠু ও সুশৃংখল ব্যবস্থাপনার দিকে সর্বদা লক্ষ্য রাখতে হবে। স্বীয় মত প্রতিষ্ঠার একগুঁয়েমী ভাব যাতে কারো মাঝে সৃষ্টি না হয়- সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। আল্লাহ না করুন যদি এমন অবস্থা দেখা দেয় যে- উপদেষ্টাগণ স্ব-স্ব মতের বিরোধিতা কিংবা অন্যের মতামতকে সমর্থন করার বিষয়টি সহনশীলতার সাথে গ্রহণ করতে পারছেন না; তাহলে এ প্রতিষ্ঠানের ভিত্তিমূল নড়বড়ে হয়ে পড়বে। যথাসম্ভব মুক্তমনে পরামর্শ দিতে হবে এবং অগ্র-পশ্চাতে মাদরাসার শৃংখলা রক্ষার বিষয়টিই লক্ষ্যণীয় হতে হবে। স্ব-মত প্রতিষ্ঠার মনোভাব রাখা যাবে না। এজন্য পরামর্শদাতাকে মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে তার মতামত গ্রহণীয় হওয়ার ব্যাপারে অবশ্যই আশাবাদী হওয়া চলবে না। পক্ষান্তরে শ্রোতাদের মুক্ত মন ও সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে তা শ্রবণ করতে হবে। অর্থাৎ এরুপ মনোভাব রাখতে হবে- যদি অন্যের মতামত যুক্তিযুক্ত ও বোধগম্য হয় তাহলে তা নিজের মতের বিপরীত হলেও গ্রহণ করে নেয়া হবে। আর মুহতামিম বা পরিচালকের জন্য পরামর্শ সাপেক্ষে সম্পাদনীয় বিষয়ে উপদেষ্টাগণের সাথে পরামর্শ করে নেয়া অবশ্যই জরুরি হবে। তবে মুহতামিম নিয়মিত উপদেষ্টাদের থেকেও পরামর্শ গ্রহণ করতে পারবেন কিংবা তাৎক্ষণিকভাবে উপস্থিত এমন কোন বিদগ্ধ জ্ঞানী আলেম থেকেও পরামর্শ গ্রহণ করতে পারবেন যিনি এ সকল দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের জন্য হিতাকাঙ্ক্ষী ও কল্যাণকামী। তবে যদি ঘটনাক্রমে উপদেষ্টা পরিষদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্যের সাথে পরামর্শক্রমে কাজ করে ফেলা হয় তবে কেবল এজন্য অসন্তুষ্ট হওয়া উচিত হবে না যে, আমার সাথে পরামর্শ করা হল না কেন? কিন্তু যদি মুহতামিম কারো সঙ্গেই পরামর্শ না করেন তাহলে অবশ্যই উপদেষ্টা পরিষদ আপত্তি করতে পারবে।
৪। মাদরাসার সকল মুদাররিসীনকে অবশ্যই সমমনা ও একই চিন্তা চেতনার অনুসারী হতে হবে। সমকালীন দুনিয়াদার আলেমদের ন্যায় নিজ স্বার্থ প্রতিষ্ঠা ও অন্যকে হেয় প্রতিপন্ন করার দুরভিসন্ধিতে লিপ্ত হওয়া যাবে না। আল্লাহ না করুন, যদি কখনো এরুপ অবস্থা দেখা দেয়, তবে মাদরাসার জন্য এটি মোটেই শুভ ও কল্যাণকর হবে না।
৫। পূর্ব থেকে যে পাঠ্যসূচী নির্ধারিত রয়েছে কিংবা পরবর্তীতে পরামর্শের ভিত্তিতে যে পাঠ্যসূচী নির্ধারণ করা হবে, তা যাতে সমাপ্ত হয়; এই ভিত্তিতেই পাঠদান করতে হবে। অন্যথায় এ প্রতিষ্ঠান সুপ্রতিষ্ঠিত হবেই না, আর যদি হয়ও তবু তা ফায়দাজনক হবে না।
৬। এ প্রতিষ্ঠানের জন্য যতদিন পর্যন্ত কোন স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হবে; ততদিন পর্যন্ত আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীলতার শর্তে তা এমনিভাবেই চলতে থাকবে ইনশাআল্লাহ। কিন্তু যদি স্থায়ী আয়ের কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, যেমন- কোন জায়গীর লাভ, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, মিল ফ্যাক্টরি গড়ে তোলা কিংবা বিশ্বস্ত কোন আমীর উমারার অনুদানের অঙ্গীকার ইত্যাদি, তাহলে এরুপ মনে হচ্ছে যে, আল্লাহর প্রতি ভয় ও আশার দোদুল্যমান অবস্থা; যা মূলতঃ আল্লাহ অভিমূখী হওয়ার মূল পুঁজি; তা হাতছাড়া হয়ে যাবে এবং গায়েবী সাহায্যের দ্বার রুদ্ধ হয়ে যাবে। তদুপরি প্রতিষ্ঠানের কর্মী ও কর্মচারীগণের মাঝে পারস্পরিক বিদ্বেষ ও কলহ বিবাদ দেখা দিবে। বস্তুতঃ আয়-আমদানি ও গৃহাদী নির্মাণের বিষয়ে অনেকটাই অনাড়ম্বরতা ও উপায় উপকরণহীন অবস্থা অবলম্বন করার প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।
৭। সরকার ও আমির উমারাদের সংশ্লিষ্টতাও এ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতির কারণ হবে বলে মনে হচ্ছে।
৮। যথাসম্ভব এমন ব্যক্তিদের চাঁদাই প্রতিষ্ঠানের জন্য অধিক বরকতময় বলে মনে হচ্ছে; যাদের চাঁদা দানের মাধ্যমে সুখ্যাতি লাভের প্রত্যাশা থাকবে না। বস্তুতঃ চাঁদা দাতাগণের নেক নিয়্যাত প্রতিষ্ঠানের জন্য অধিক স্থায়িত্বের কারণ হবে বলে মনে হয়।
১৮৬৬ সালের ৩০শে মে ছাত্তা মসজিদের বারান্দায় ডালিম গাছের নিচে মাত্র একজন উস্তাদ মোল্লা মাহমুদ ও মাত্র একজন ছাত্র মাহমুদুল হাসানকে দিয়ে যে ইলমী বাতিঘরের গোড়াপত্তন করা হয় কালের আবর্তনে সেই বাতিঘরের লক্ষ লক্ষ শাখা প্রশাখা আজ সারা বিশ্বের আনাচে কানাচে ইলমের নূর ছড়িয়ে যাচ্ছে।

কাওমী মাদরাসার অবদান:

সারাবিশ্বে ইসলামের বাতিটি আজো মিটিমিটি জ্বলছে। ইসলামের শাজারায়ে তাইয়্যেবাহ আজও ডাল-পালা-পত্র-পল্লবে তরুতাজা আছে। এর পিছনে ইসলামের সবধরণের খাদেমের অবদান অনস্বীকার্য। তবে একটু গভীরে গিয়ে অনুসন্ধিৎসু মনোভাব নিয়ে চিন্তা করলে দেখা যাবে- বিশ্বের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাওমি মাদরাসাগুলোর ত্যাগী উলামায়েকিরাম এক্ষেত্রে অগ্রগামী। তাঁরা জাতির কল্যাণের দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে নিজকে বিলিয়ে দেয়ার প্রস্তুতি নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছেন। দাড়ি, টুপি, পাঞ্জাবী, পাগড়ী ইত্যাদি লেবাসে-পোশাকে, চাল-চলনে, কথা-বার্তায়, আদব-আখলাকে, সুন্নাতের পাবন্দে তারা আসহাবে সুফ্ফার রং-এ রঙিন।

বাতিল প্রতিরোধে উলামাদের ভূমিকা:

যুগের সর্বোৎকৃষ্ট লোক উলামায়েকেরামের দায়িত্ব নিকৃষ্ট কুসংস্কারমূলক সবধরণের নোংরামী থেকে সমাজকে মুক্ত করা। সর্বযুগেই মুসলিম সমাজে ইসলামের নাম ভাঙ্গিয়ে বকধার্মিক কপট, একশ্রেণির ভণ্ড মানুষের উদ্ভব ঘটেই থাকে। এরা সমাজের ইলমহীন মানুষদের মধ্যে ব্যাঙের ছাতার ন্যায় গজে উঠে। মানুষেরা তাদের মিষ্টি কথায় ধোকায় পড়ে। যেহেতু সাধারণ মানুষ ভাল-মন্দ পার্থক্য করতে জানে না, তাই সহজে তারা ভন্ডদের কবলে পড়ে ঈমান-আমল সবকিছু হারিয়ে ফেলে। অনেক ভন্ড আছে যারা নামাজ পড়ে না অথচ রুহানী পিতা সেজে শরীয়তের পর্দার খেলাপ করে প্রকাশ্যে বেগানা মহিলাদের হাত ধরে মুরীদ বানায়। অনেকে মাথায় টুপি পরে না। এ জাতিয় বহু ভন্ড গাঁজা খেয়ে সারিন্দা, তবলা ইত্যাদি বাজিয়ে জারীগানের মাধ্যমে যিকিরের নামে নারী-পুরুষ একসাথে নেচেগেয়ে ফুর্তি করে। এরাই গরম তরীকার বাহানায় গরুর গোস্ত খাওয়া তো দূরের কথা- দেখা মাত্র ঘৃণায় বমি করে ফেলে। এলাকার কোথাও গরু জবাই করলে সেখানে কারবালা ময়দান কায়েম হবে বলে ঘোষণা দেয়। উলামায়েকিরাম ওয়াজ-নসীহত, লেখালেখি ইত্যাদির মাধ্যমে এসব গাঁজা বাবা, জারী বাবা, নেংটা বাবা, পাগলা বাবা ইত্যাদি ভন্ডদের মুখোশ উন্মোচন করতঃ ধর্মভীরু সরলমনা উম্মতের ঈমান আমল হিফাজত করার গুরুদায়িত্ব পালন করে থাকেন।
নবুওয়াতের প্রাক যুগে প্রায় দীর্ঘ ছয়শত বছর ধরে বাতিলের যে অন্ধকার মেঘমালা সারাবিশ্বকে ছেয়ে ফেলেছিল, হকের বাতি কুরআনের আলো এসে বাতিলের সে অমানিশা অন্ধকারকে দূর করে দেয়।
ﻭ ﻗﻞ ﺟﺎﺀ ﺍﻟﺤﻖ ﻭ ﺯﻫﻖ ﺍﻟﺒﺎﻃﻠﻂ ﺍﻥ ﺍﻟﺒﺎﻃﻞ ﻛﺎﻥ ﺯﻫﻮﻗﺎ 
এবং বল, ‘হক আসিয়াছে এবং বাতিল বিলুপ্ত হইয়াছে;’ বাতিল তো বিলুপ্ত হবারই। (সূরা বনী ইসরাঈলঃ ৮১)

উলামায়ে দ্বীন: কুরআন শিক্ষাদানে
কুরআনুল কারীম মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থ। সর্বধর্মাবলম্বীদের ঐক্যমতে শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। কুরআন মুসলমানদের অহংকার। অর্থ ব্যাখ্যাসহ না বুঝলেও কমপক্ষে দেখে দেখে পড়তে পারাও মুসলমানের জন্য গর্বের বিষয়। কেউ কুরআন পড়তে না জানলে নিজের থেকেই নিজেকে ছোট মনে হয়। মনে হয় আমার মাঝে বড় একটি অধ্যায় শূন্য। আর কুরআন পড়তে জানাকে নিজের জন্য বিরাট ‘পাওয়া’ বলে মনে হয়। আর হবেই না কেন- কুরআনই তো মুসলমানের জন্য আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে সবচেয়ে বড় নিয়ামত।
হাদীসে বর্ণিত আছে, রাসূল সা. হযরত আবু হুরায়রা রা. কে লক্ষ্য করে বলেছেন, ওহে আবু হুরায়রা! তুমি মৃত্যু পর্যন্ত কুরআন শিখতে থাক এবং অন্যকে শিক্ষা দিতে থাক। কারণ, যদি তুমি এ অবস্থায় মৃত্যুবরণ কর তাহলে আল্লাহর ফিরিশতাগণ তোমার কবর যিয়ারত করতে থাকবে যেমন নাকি তারা কা’বা শরীফ যিয়ারত করে থাকে। (বুখারী)
সুবহানাল্লাহ্, আল্লাহর রাসূল সা. কুরআন শেখা- শেখানোর কতই ফযীলত বয়ান করেছেন। যারা কুরআন পড়বে পড়াবে তারা সবচেয়ে বড় নিয়ামতের অধিকারী। যেই চারটি কাজের দায়িত্ব দিয়ে আল্লাহ তায়ালা রাসূলুল্লাহ সা. কে দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন এটি তার অন্যতম। এখন আসুন, মুসলিম সমাজকে কুরআন শিক্ষা দিচ্ছে কারা? কারা তাদেরকে মহান সৌভাগ্যের দ্বার প্রান্তে পৌঁছে দিচ্ছে? কারা মুসলিম সমাজের বাচ্চাদের কুরআন শিখিয়ে তাদের ও তাদের মা-বাবাকে পরকালে নূরের টুপির অধিকারী হবার সুযোগ করে দিচ্ছে? কোন বড় বৈজ্ঞানিক, কোন বড় অধ্যাপক? না কি মাওলানা- মৌলবীরা?
উলামায়ে দ্বীন: তাবলীগের দায়িত্বে
রাসূলুল্লাহ সা. কে যেই দাওয়াত ও তাবলীগের দায়িত্ব দিয়ে দায়ী বানিয়ে উম্মতের হিদায়াতের জন্য জগতে প্রেরণ করা হয়েছিল- রাসূলুল্লাহ সা. এর অবর্তমানে সেই দায়িত্ব প্রথমেই অর্পিত হয় রাসূল সা.এর ওয়ারিস উলামায়ে কিরামের উপর।

সারা বিশ্বজুড়ে আজ প্রতিটি ধর্মের অনুসারীরা তাদের স্ব স্ব ধর্মকে ব্যাপকতর রুপ দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। বিশেষতঃ খৃষ্টান ধর্মাবলম্বীরা সারা দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। সেবার আড়ালে শিক্ষার নামে চিকিৎসার ছদ্মাবরণে আজ তারা সারা বিশ্বে এক সুপরিকল্পিত মিশন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এহেন পরিস্থিতিতে ইসলাম ধর্ম প্রচারে একটি নীরব অথচ বলিষ্ঠ আন্দোলন চলছে ‘দাওয়াত ও তাবলীগের’ নামে। এক আত্মত্যাগী কাফেলার তত্ত্বাবধানে অল্পদিনের মধ্যেই এ মেহনত সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। নিজের খেয়ে, নিজের পরে, নিজ খরচে এ কাফেলা দ্বীনি দাওয়াত নিয়ে গোটা বিশ্ব জুড়ে ছুটে চলেছে। প্রতারক দুনিয়ার চাকচিক্যময় রঙ্গিন ফানুসে আকন্ঠ নিমজ্জিত মুসলমান আজ ঈমানী দূর্বলতার শিকার। এহেন দূরাবস্থায় তারা মুসলমানদিগকে ‘আমর বিল মারুফ নেহী আনিল মুনকারের’ দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছে। এ উছিলায় অসংখ্য ভুল পথের পথিক সত্যের সন্ধান পাচ্ছে। তাদের জীবনকে ইসলামের আলোকে পরিচালনা করার সৌভাগ্য অর্জন করতে সক্ষম হচ্ছে। আমেরিকা ইউরোপসহ সারা বিশ্বজুড়ে অচেতন মুসলমানদের মাঝে আজ দ্বীনি চেতনা উদয় হচ্ছে। এ দাওয়াতী কাফেলার উত্তম আখলাক, মুয়ামালাত, মুয়াশারাত-এ মুগ্ধ হয়ে অসংখ্য অমুসলিমও ইসলামের ছায়াতলে আসছে। মোটকথা তাবলীগের উসীলায় আজ সারা দুনিয়াজুড়ে এক ঈমানী আন্দোলন মজবুতভাবে চালু হয়েছে।

উলামায়ে দ্বীন: বেকারত্বের অভিশাপ মোচনে
ঈমান ও মানবতা বিধ্বংসী একটা মিথ্যা প্রোপাগান্ডা মুসলিম সমাজকে বিপথে ঠেলে দিয়ে বিভ্রান্তির বেড়াজালে অক্টোপাসের মত আটকে ফেলে গ্রাস করছে। তা’ হল- মাদরাসাগুলো বেকার তৈরির কারখানা, আলেম-উলামা-মাওলানা-মৌলবীরা বেকার জনগোষ্ঠী, সমাজের ঘাড়ে বাড়তি বোঝা, পরনির্ভরশীল, পশ্চাদপদ, কর্মবিমূখ, এরাই দেশটাকে শেষ করলো, এদের কারণে জাতি বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরিত। দেশের বড় বড় সমস্যার মধ্যে বেকার সমস্যা অন্যতম। এজন্য মাদরাসাগুলোই একমাত্র দায়ী।
আসলেও কি তাই? রাসূলুল্লাহ সা. সার্টিফাই করছেন, ইলমের সাথে সংশ্লিষ্ট তালেবে ইলম, আলেম-উলামার উসিলায় অন্যেরা রিযিক পায়। আর ঘুণে ধরা সমাজের ঘুণাক্রান্ত তথাকথিত বিভ্রান্ত পন্ডিত, বুদ্ধিজীবিরা প্রচার করছেন, উল্টো কথা। বাস্তবে কোনটি সত্য? সাদেকুল মাসদুক আল আমিন সা. এর সত্য বাণী? নাকি যুগের আবু জাহাল, আবু লাহাব, উমাইয়া বিন খালফদের বকোয়াস, প্রলাপ ও চাপাবাজি, কলমবাজি? রাসূলুল্লাহ সা. এর ভাষ্যমতে- সমাজে যে যতবড় করিৎকর্মাই হোক না কেন, সে শুধু কলুর বলদের মত খেটেই যাবে কিন্তু তার ভাগ্যে যতটুকু রিযিক আল্লাহ তায়ালা নির্ধারণ করে রেখেছেন তা সে পাবে, তালেবে ইলম ও আলেম-উলামার ইলম ও আমলের উছিলায়। বিষয়টি মেনে নিতে কষ্ট হলেও এটাই বাস্তব সত্য। এখন কথা হলো- যাদের উপর অন্যের রিযিক নির্ভরশীল তারা কিভাবে বেকার হয়? তারা কিভাবে পরমুখাপেক্ষী হয়? বরং অন্য সবাই তাদের প্রতিই মুখাপেক্ষী। এ সত্যটি যত তাড়াতাড়ি অনুধাবন করা যায় ততই মঙ্গল। তালেবে ইলম, আলেম-উলামা জাতির ঘাড়ে বাড়তি বোঝা নয়; বরং গোটা জাতির রুটি-রুজির সংস্থান করার গুরুদায়িত্বের ভারী বোঝার পাহাড় মাথায় নিয়ে তাঁরা গোটা জাতিকে নিজেদের প্রতি দায়বদ্ধ করে রেখেছেন। দায়বদ্ধ জাতি যদি দাতাকেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে যায় তাহলে সে জাতির ভাগ্যে বিজাতির লাথি-গুড়ি ছাড়া আর কি জুটতে পারে?
মাদরাসা বেকার তৈরীর কারখানা নয়; বরং আদর্শ মানুষ গড়ার উৎপাদনমূখী শিল্প কারখানা।

এ কারখানার পণ্য উৎপাদনের ফর্মূলা, নিয়ম কানুন, পরিবেশ, পারিপার্শ্বিকতা, আবহাওয়া, গতিপ্রকৃতি ইত্যাদি সবকিছুর সাথে নিজকে খাপ খাইয়ে এক কথায় এর মালিক, পরিচালক, কর্মকর্তা, কর্মচারী সকলের মানশা ও চাহিদার মানদন্ডে উত্তীর্ণ হয়ে কোন মানুষ যদি কুরআন, হাদীস, ফিকাহ, তাফসীর ইত্যাদির ইলম অর্জন করতঃ আলেম, হাফেজ, মুফতী, মুহাদ্দিস, মুফাচ্ছির হতে পারেন এবং এ ক্ষেত্রে ইখলাস, মুজাহাদা, কুরবানীর শর্ত পূরণ করতে সক্ষম হন এবং তৎসঙ্গে ইলমের চাহিদামত আমল করতে পারেন এবং সারাজীবন নিজেকে ইলমের খিদমতে বিলিয়ে দেয়ার প্রত্যয় নিয়ে এ পথে চলতে আরম্ভ করেন- তাহলে নিশ্চিত জেনে রাখুন- এ মানুষটি কোনদিনই বেকার- অচল, অপাংক্তেয় নয়। এমন খাঁটি পণ্য বাজারে অচল হয় না। আল্লাহ তায়ালা এমন মানুষকে বেকার ফেলে রাখেন না। কোন না কোন সম্মানজনক কাজে লাগিয়ে রাখেন। খোলামনে অনূসন্ধিৎসূচিত্তে নিরপেক্ষ জরিপ চালিয়ে দেখুন, এমন সোনার মানুষের দরবারের চৌকাঠ ক্ষয়ে যাচ্ছে আমার আপনার মতো লাখো দুনিয়াদার, মালদার, মান্য-গণ্য পদের বাহাদুরদের পায়ের জুতার তলা ক্ষয়ে যাওয়ার দ্বারা। কত মালদারের চোখের গরম পানি গড়িয়ে পড়ে এমন মানুষদের হাতে পায়ে। এ সত্য অনূধাবনে বড় অন্তরায়- এঁদের সাহচর্য লাভে ব্যর্থতা। দূর থেকে এঁদের চেনা যায় না।
হ্যাঁ! প্রতিটি কারখানা থেকেই কিছু না কিছু বর্জ্জ পদার্থ বের হয়েই থাকে। বর্জ্জ মানে উৎপাদিত পণ্য নয়। বর্জ্জ বর্জ্জই। বর্জ্জ দিয়ে কারখানার বা পণ্যের মান নির্ণয় করা বোকামী। এছাড়াও কোন কারখানা থেকে সব পণ্যই Export quality/ Best quality product হয় না। বিভিন্ন মানের পণ্যই উৎপাদিত হয়। তাই বলে কি ঐ কারখানা Rejected? আদর্শ মানুষ গড়ার কারখানা থেকে বর্জ্জ কিংবা অচল মাল একেবারেই বের হয় না- এমনটি দাবী করার কোনই যৌক্তিকতা নেই। তবে কি স্কুল-কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মানোত্তীর্ণ মানব সম্পদের পাশাপাশি অচল অপাংক্তেয় মাল একেবারেই বের হয় না? তাহলে লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার যুবকের সুবিশাল ও সুদীর্ঘ বহর কি সবই মাদরাসার তৈরি? সত্য প্রকাশে দ্বিধা-সংকোচ ও কার্পণ্য না করলে নির্ভিকচিত্তে বলতেই হয়- তুলনামূলক বিচারে মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিত বেকারের হার কোনক্রমেই সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত বেকারের তুলনায় বেশী নয়। দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক বিষয় হল, তুলনামূলক অধিক হারে বেকার সৃষ্টির কারখানা থেকে উৎপাদিত সম্পদকে ‘মানব সম্পদ’ উপাধি দেয়া হয়। অথচ আদর্শ মানুষ গড়ার আদর্শ কারখানা থেকে উৎপাদিত সর্বশ্রেষ্ট মানুষগুলো জাতির কল্যাণে নিজকে সর্বস্ব বিলিয়ে দেয়ার পরও তাদেরকে মানব সম্পদের মর্যাদা দিতে জাতি অনীহা প্রকাশ করে অথবা বিব্রতবোধ করে কিংবা অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে, কার্পণ্য করে। এটা জাতির জন্য অবমাননাকর, অকৃতজ্ঞতা ও দুর্ভাগ্যের পরিচায়ক।

জেনে রাখা ভাল- আলেম-উলামারা, পীর-মাশায়েখ, মাওলানা-মৌলবীরা জাতির ঘাড়ে বাড়তি বোঝা কিংবা পরনির্ভরশীল অথবা কর্মবিমূখ- উৎপাদন বিমূখ ইত্যাদি কিছুই নয়; বরং আমরা সমাজের যে অংশটিকে মানব সম্পদ বলে গর্ব করছি, সেই অংশটুকুই একমাত্র জাতির ঘাড়ে বোঝার পাহাড় ও পরমূখাপেক্ষী।
উলামায়ে দ্বীনঃ আদর্শ সমাজ ও জাতি গঠনে অনুসরণীয় ও প্রয়োজনীয়তার শীর্ষে
সমাজ মানেই বিভিন্ন পেশাজীবি মানুষের সামষ্টিক রুপ। যে কোন সমাজেই বিভিন্ন ধরণের পেশাজীবি থাকবে। প্রশাসক, আমলা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিচারক, উকিল, ব্যারিষ্টার থেকে আরম্ভ করে শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবি, শ্রমজীবি, কৃষক, মজুর, কুলি, কামার, কুমার, ছুতার, মুচি পর্যন্ত এর পরিধি বিস্তৃত। তবে যেকোন সমাজ মানেই আদর্শ সমাজ নয়; বরং আদর্শ মানুষ দ্বারা গড়ে উঠা সমাজই কেবল আদর্শ সমাজ। শিক্ষিত সমাজ, বুদ্ধিজীবি সমাজ, আধুনিক সমাজ, উন্নত সমাজ, প্রগতিশীল সমাজ, সুশীল সমাজ, বিত্তশালী সমাজ ইত্যাদি মানেই কিন্তু আদর্শ সমাজ নয়। আদর্শ সমাজের একটা ভিন্ন সংজ্ঞা রয়েছে, ভিন্ন রুপরেখা রয়েছে। আর এই সংজ্ঞা ও রুপরেখা কোন বুদ্ধিবৃত্তিক নয়; বরং অহী ভিত্তিক। আদর্শ সমাজের আসল রুপকার আল্লাহ তায়ালা। তিনি আম্বিয়ায়েকিরামকে দিয়ে এর গোড়া পত্তন করে নিয়েছেন। আদর্শ সমাজের আসল স্থপতি হযরাতে আম্বিয়ায়েকিরামই। তন্মধ্যে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও তাঁর অনুসারীগণ অন্যতম। আম্বিয়ায়েকিরাম প্রবর্তিত সমাজ কাঠামোই আদর্শ সমাজের একমাত্র মডেল, অদ্বিতীয় নমূনা। আম্বিয়ায়েকিরাম প্রবর্তিত আদর্শ কেবলমাত্র নিছক আদর্শই নয়; বরং সর্বোত্তম আদর্শ।
আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘‘তোমাদের জন্য ইব্রাহীম ও তাঁহার অনুসারীদের মধ্যে রহিয়াছে উত্তম আদর্শ।’’ (সূরা মুমতাহিনাঃ ৪)
‘‘তোমরা যাহারা আল্লাহ ও আখিরাতের প্রত্যাশা কর নিশ্চয় তাহাদের জন্য রহিয়াছে উত্তম আদর্শ তাহাদের (ইব্রাহীম ও তাঁহার অনুসারীদের) মধ্যে।” (সূরা মুমতাহিনাঃ ৬)
আল্লাহ তায়ালা আমাদের নবী (সাঃ) কে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও তাঁর অনুসারীদের আদর্শ অনুকরণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন- ‘‘বল, আল্লাহ সত্য বলিয়াছেন। সুতরাং তোমরা একনিষ্ঠ ইব্রাহীমের ধর্মাদর্শ অনুসরণ কর, সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নহে।” (সূরা আলে ইমরানঃ ৯৫)
সর্বোত্তম আদর্শের একমাত্র ধারক-বাহক ও সংগঠক উলামায়ে কিরাম এজন্য যে, ‘সর্বোত্তম আদর্শ’ যে শিক্ষার মাধ্যমে অর্জন করা যায়, তার নাম- ইলমে অহী। এই ইলমে অহীর একমাত্র সার্থক ধারক-বাহক উলামায়েকিরাম। কেননা সমাজের অন্যান্য পেশাজীবি ও বিশেষজ্ঞ মহল যেসব প্রতিষ্ঠান ও পরিবেশে জ্ঞানার্জন করে থাকেন- সেসব প্রতিষ্ঠান ও পরিবেশে অহীর ইলম বলতে গেলে অনুপস্থিতই থাকে। তাদের শিক্ষা ও পাঠ্যসূচীতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের লক্ষ কোটি শাখা-প্রশাখা ও ফাকাল্টি অন্তর্ভূক্ত থাকলেও ইসলাম ধর্ম শিক্ষা, ইসলামিক ষ্টাডিজ ইত্যাদি নামে যে চটি সিলেবাস নামমাত্র রাখা হয়েছে তা দিয়ে তো মুহাক্কিক আলেম হওয়া যায় না, বড়জোর পাশের মান বাড়ানোর জন্য ৫০-৬০ নম্বর সংযোজিত হয়।

সমাজে যে যেই পেশায় নিয়োজিত থাকুক না কেন- তার পেশাগত দায়িত্ব পালনে আলেমে দ্বীনের দিকনির্দেশনা মেনে চলা ও অনুসরণ করা তার জন্য ফরযে আইন। নইলে পেশাগত দায়িত্ব পালনে তার আদর্শচ্যুতি ঘটা অনিবার্য। ﻓﺎﺳﺌﻠﻮﺍ ﺍﻫﻞ ﺍﻟﺬﻛﺮ ﺍﻥ ﻛﻨﺘﻢ ﻻ ﺗﻌﻠﻤﻮﻥ শুধু ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে কেন? প্রতিটি কাজেই আলেমে দ্বীনের পথ নির্দেশনাকে অনুসরণ করা ফরয। বাবা-মা’র বিয়ের অনুষ্ঠানে কালেমা পড়ানো থেকে আরম্ভ করে আমার জন্মের পর আকিকার মাধ্যমে নাম রাখা, মুখে মিষ্টি খেজুরের বরকত দেয়া, পাঁচ ওয়াক্ত নামায, জুমু’আ ও ঈদের নামায-খুতবা এবং মৃত্যুর পর জানাযার নামায ইত্যাদিতে যেমন আলেমে দ্বীনকে মান্য করে চলা ছাড়া কোন উপায় নেই- তেমনি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিটি পেশায় আলেমে দ্বীনকে অনুসরণ না করে উপায় নেই। হুযুরের কালেমা পড়ানো ছাড়া যেমন বাবা-মা’র বিয়ে বৈধ হয় না, বৈধ সন্তান কল্পনা করা যায় না, আদর্শ মানুষের জন্ম দেয়া সম্ভব হয় না- তেমনি আলেমে দ্বীনের নির্দেশনা ছাড়া সমাজের কোন কাজই বৈধ ও আদর্শ ভিত্তিক হতে পারে না। আমি যত বড়ই শিক্ষিত, পদধারী অথবা বিত্তশালী হই না কেন- মসজিদে, ঈদগাহে, জুমু’আ ও জামাতে ঐ জীর্ণশীর্ণ হুযুরের পিছনেই ইকতিদা করতে হয়, খুতবার সময় তাঁর মুখের দিকেই ভক্তি ও আদবের সাথে চেয়ে থাকতে হয়। স্থায়ী যিন্দেগীর অমূল্য পুজি অর্জনে যদি আমাকে আলেমে দ্বীনের মুখাপেক্ষী হতেই হয়Ñ তাহলে এই তুচ্ছ অস্থায়ী দুনিয়াবী যিন্দেগীর মূল্যহীন কাজকর্ম সর্বোত্তম আদর্শের ধারক-বাহক আলেমে দ্বীনকে এড়িয়ে চলা ও অবজ্ঞা করা কিভাবে সম্ভব? নিজের স্বার্থে, সমাজের স্বার্থে ও জাতির স্বার্থে এক কথায় মানবতার স্বার্থেই আলেমে দ্বীনকে অনুসরণ করা অপরিহার্য। তাই তাঁদের প্রয়োজনীয়তা সবার শীর্ষে।
উলামায়ে দ্বীনঃ ফাত্ওয়া প্রদানে
মানুষের জীবনে সার্বক্ষণিক সমস্যা লেগেই থাকে। কিছু থাকে পার্থিব সমস্যা যা কোন বস্তুর দ্বারা সমাধান হয়। আর কিছুু দ্বীনি সমস্যার সন্মুখীন হতে হয়, যার জন্য ধর্মীয় সমাধানের প্রয়োজন পড়ে। মুসলমানদের জীবনে বিবিধ সমস্যা দেখা দেয় যার সমাধান কুরআন হাদীসে দেয়া আছে। আর কুরআন হাদীস তো সকলের জন্য বুঝা সম্ভব নয়। এজন্য ধর্মীয় ফিকাহবিদ মাওলানা মৌলবীর দ্বারস্থ হতে হয়, মাদরাসাগুলির দিকে দৌড়াতে হয়। আর জনসাধারণের এ সমস্যাবলী সমাধানের জন্য কাওমী মাদরাসার আলেমগণ সোৎসাহে এগিয়ে আসেন। প্রত্যেক বড় বড় কাওমী মাদরাসা গুলোতে ফাত্ওয় বিভাগ রয়েছে। সেখানে রয়েছে কুরআন হাদীস থেকে সংগৃহিত ফাত্ওয়ার কিতাবাদীর বিশাল ভান্ডার ও মুহাক্কিক মুফতীয়ে কিরামগণ। তাঁরা সেখান থেকে প্রতিনিয়ত ফতুয়া প্রদান করছেন। বাংলাদেশেই দৈনন্দিন শত শত ফাত্ওয়া বিভাগ থেকে হাজার হাজার ফতুয়া বের হচ্ছে। আর এর দ্বারা উপকৃত হচ্ছে মুসলিম সমাজ। এভাবে ফাত্ওয়া প্রদানের মাধ্যমে জাতির এক মহান সেবায় নিয়োজিত আছেন অসংখ্য মুফতিয়ে কিরাম। আশ্চর্য হবার কথা, একজন চিকিৎসক শারীরিক সমস্যার সমাধানকল্পে মুখস্থ দু’ এক লাইন লিখে দিয়ে সাথে সাথে ৫০০/১০০০ টাকা নিয়ে নিচ্ছেন। অথচ মুফতীগণ ফাত্ওয়ার বিনিময়ে একটি পয়সাও নিচ্ছেন না; বরং যে কাগজে সমাধান লিখে দিচ্ছেন তা ও নিজের পয়সায় ক্রয়কৃত।

উলামায়ে দ্বীন; বড় দাতা ও আখিরাতের বাদশাহ:
হযরত আনাস ইবনে মালেক রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ রা. একদিন আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা বলতে পার কি দানের দিক দিয়ে সর্বাপেক্ষা বড় দাতা কে? সাহাবীগণ উত্তর করলেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই অধিক অবগত। রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, দানের দিক দিয়ে আল্লাহই হচ্ছেন সর্বাপেক্ষা বড়। অতঃপর বনী আদমের মধ্যে আমিই সর্বাপেক্ষা বড় দাতা। আর আমার পর বড় দাতা হচ্ছে সেই ব্যক্তি- যে ’ইলম শিক্ষা করবে এবং তা বিস্তার করতে থাকবে; কিয়ামতের দিন সে একাই (দলবলসহ) একজন বাদশাহ অথবা একটি উম্মত হয়ে উঠবে। (বায়হাকী)
যেহেতু ইলমের চেয়ে বড় কোন সম্পদ নেই সেহেতু ইলম দানকারীর চেয়ে বড় দাতা আর কেউ হতে পারে না।

লেখক : সম্পাদক, মাসিক কলমদানি, বগুড়া

হিন্দুদের বীরত্বগাথা ইতিহাস (!)

• এরা তো সেই হিন্দু, যাদের রাজা লক্ষণ সেন বখতিয়ারের মাত্র ১৮ অশ্বারোহীর ভয়ে পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়েছে !
• এরা তো সেই কাপুরুষজাতি,
যাদেরকে মাত্র সতের বছরের বিন কাসিম সেই আরব থেকে এসে সিন্ধু পর্যন্ত তাড়িয়ে এনেছিলেন !
• এরা তো সেই হনুমানপুজারি,
যাদেরকে সুলতান মাহমুদ গজনবি সতের
বার পরাজিত করে সোমনাথের মুর্তি
সংহার করেছেন !
• এরা তো সেই মারাঠা হিন্দু, যাদের তিন
লক্ষ সেনাকে আহমদ শাহ আবদালির
মাত্র সাত হাজার মুজাহিদ পানিপথের
ময়দানে পরাভূত করেছেন !
ইতিহাস পড়ে দেখুন, মুসলমানরা
অন্যকোনো জাতিকে এতো তাড়াতাড়ি
পরাজিত করেন নি, যেভাবে হিন্দুদের
পরাজিত করেছেন । এই ভারতের
হিন্দুদের অধিকাংশ ইতিহাস কেটেছে
পরাজিত হিসেবে ।
হিন্দুরা যদি যুদ্ধের পথ ছেড়ে শৃগালের
চাতুরতার পথ না ধরত, তাহলে তারা আজো
আমাদের দাস হয়ে থাকতো ।
আচ্ছা, আজ পর্যন্ত কখনো
শুনেছেন, হিন্দুরা ভারতবর্ষ ছেড়ে অন্যকোনো ভু-খন্ডের এক ইঞ্চি জায়গা দখল করতে ? ১৯৭১ইং সনে এরা
তো ধুতি মাথায় উঠিয়ে বাংলাদেশ
ছেড়ে ভারত পালিয়েছিল !
তাহলে তারা বীর হয় কীভাবে ?
হ্যা, রামায়ন-মহাভারতে তাদের অর্জুন- কর্জুন নামে কিছু বীর আছেন । যাদের নাম শুধু পৃষ্ঠাকে কালো
করেছে, এদের না আছে বাস্তবতা, না
আছে ভিত্তি !
এবার আসুন, সাম্প্রতিক হিন্দু রাজ্য ভারতের কিছু বীরত্ব জানার চেষ্টা
করি !
………………………………..
• পাকিস্তানের সাথে তাদের বেশ
কয়েকবার যুদ্ধ হয়েছে, কারগিলের
যুদ্ধ, ‘৬৫ টির যুদ্ধ ইত্যাদি । প্রায় প্রতিবারই
তারা পাকিস্তানের হাতে রামধোলাই
খেয়েছে ।
• ষাটের দশকে চীনের সাথে
তাদের লড়াই হয়, তখনো চীনাবাদাম
খেয়েছে । এখনো ভারতের এমন
কিছু এলাকা আছে, যেখানে চীনা
সেনারা তাদের সাথে বাংলাদেশকে
নিয়ে বিএসএফের যেমন আচরণ
তেমন আচরণ করে ।
• আর বাংলাদেশের বিডিআরের সাথে
তো ২০০১ সালে সীমান্তে যুদ্ধ হয়। সেখানে ৫ বিডিআরের
মোকাবেলায় ১৫০ বিএসএফ কুপোকাত
হয় ।
• কাশ্মীরের জনসংখ্যা মাত্র ১কোটি ।
যার মধ্যে হিন্দু প্রায় ২৫% । আর মুজাহিদ
মাত্র ৩ থেকে ৫ হাজার ! এই ৫ হাজার
মুজাহিদের মোকাবেলায় তাদের সৈন্য
৮ লক্ষ !!!!!
যা কখনো পাক
সীমান্তের গোলযোগের সময়
১০ লক্ষে পৌছে যায় !!!
অর্থাৎ ১ জন মুজাহিদের মোকাবেলায়
১৬০ রামসেনা !!!
• এই হিন্দুদের উদ্দেশ্যেই ভারতের
মুসলিম নেতা আকবরুদ্দীন ওয়েইসি
বলেছেন, পনের মিনিটের জন্যে
ময়দান থেকে পুলিশ সরিয়ে নিলে
ভারতের মুসলমানরা ভারত দখল করে
নিবে।
দেখলেন, তাদের বীরত্ব !!! আর
এই বীরত্বের বলেই তারা ‘হিন্দুস্তান’
কে ‘রেপীস্তানে’ পরিণত
করেছে। এদের বীরত্বের
স্বীকৃতি কাশ্মীরী মুজাহিদরা একটি
নাশীদে এভাবে দিয়েছেন-
‘হিন্দি লশকর দুনিয়া ভরকে সবসে বড়া
বুযদিল হ্যায়!
আজ তারা নাকি আমাদের মসজিদ নির্মাণে
বাধা দিচ্ছে? ভারতকে এদেশে
হস্তেক্ষেপের জন্যে আমন্ত্রণ
জানাচ্ছে!!
এরা তো সোমনাথ মন্দিরের সেই
কামোন্মাদ ব্রাহ্মণ সেবকদের
উত্তরসূরি, যারা তাদের দেবতার সন্তুষ্টির
জন্য সর্বদা পাঁচশ’ নর্তকী এবং দু’শ’
গায়িকার নৃত্য-গীতির আয়োজন করত,
কুমারী মেয়েদের ধর্ষণ করত ও
বলি দিত।
এদের শায়েস্তা করতে ছুটে
এসেছিলেন সুলতান মাহমুদ গাজনবী,
যিনি এই রামসেনাগুলোর নিকট এক
অপ্রতিরোধ্য শক্তি হিসেবে আবির্ভুত
হয়েছিলেন। এদের উত্তরসূরি
বীরেরা(!) আবারো পুরো
ভারতবর্ষকে সেই সোমনাথে পরিণত
করেছে, এবং সুলতান মাহমুদের
সন্তানদের প্রলুব্ধ করছে আরেকটি
‘ভারত অভিযানে’র জন্য ও প্রকৃত
বীরত্ব কি তা বুঝিয়ে দিবার জন্য।
এখন হয়তো বলবেন, তাহলে তারা
সিকিম, জুনাগড়, বরোদা এবং হায়দারাবাদ
কীভাবে দখল করলো ?
আসলে এগুলো সিংহের বীরত্বে
নয়, বরং শৃগালের চাতুর্যে দখল
করেছে ।
আর এই হিন্দুদের বর্তমান শক্তিশালী
রাজ্য হচ্ছে ভারত । আমরা নাকি এই
ভারতকে খু-ব-ই ভয় পাই !!!
আমরা ভারতকে বলে দিতে চাই, যে
ক্ষমতার বলে তাদের লক্ষনসেন
বখতিয়ারের ভয়ে পালিয়েছিল, আমরা
সেই বখতিয়ারের বলে বলীয়ান !
যে লক্ষ্য নিয়ে বিন কাসিম সিন্ধুতে
আগমন করেছেন, আমাদেরও সেই
লক্ষ্য !
যে গগনবিদারী ধ্বনি দিয়ে আহমদ শাহ
আবদালি পানিপথের ময়দান প্রকম্পিত
করেছেন, ইনশা আল্লাহ আমরাও সেই
ধ্বনি সহকারে তাদের সামনে আবির্ভুত
হবো !
অতএব তোদের শাহজালাল আর খান
জাহানের মাটিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা,
আর পঙ্গপালের আগুনে ঝাপ দেওয়া
একই কথা !
তারপর যদি হাত বাড়াও, তাহলে রাশিয়ার
(সোভিয়েত ইউনিয়নের) পরিণতির কথা
স্মরণ করে নাও …!
সবশেষে সত্যিকারের বীরদের
উদ্দেশ্যে মাওলানা আসেম উমর
(হাফিজাহুল্লাহ)’র কিছু কথা,
‘সময় এসেছে সেই ধাতুনিঃস্রব
জিহাদের অগ্নিশিখা প্রজ্জ্বলনের যা
আপনারা নিজেদের অন্তরে দমিত
করে রেখেছেন সেই ১৮৭৫ সাল
থেকে। এখন সময় দেবত্বের
দাবীদারদের দেখানোর যে
আপনাদের শিরায় শিরায় এখনও মুহাম্মাদ বিন
কাসিম এর রক্ত দৌড়ে। এটা সময় তাদের
দেখানোর যে মুসলিম মায়েরা গাওরী
ও গাযনাবী’র কাহিনী এখনও তাদের
সন্তানদের কাছে বর্ণনা করেন। এটা
সময় তাদের দেখানোর
আওরঙ্গজেব এর লোককাহিনী
এখনও ভারতীয় মুসলিমদের বিবেক
জাগ্রত করে এবং মহিশূরের সিংহের
বিখ্যাত মন্তব্য এখনও ভারতীয় মুসলিম
যুবকদের প্রণোদিত করে মৃত্যুর
জন্য – একটি সম্মানিত মৃত্যু।
হে মুহাম্মাদ বিন কাসিমের সন্তানরা! হে
আওরঙ্গজেব ও গাযনাভীর
উত্তরসূরীরা, উঠে দাঁড়ান ও প্রতিরোধ এর দিকে অগ্রসর হোন
একজন বোনের পর্দা কেড়ে
নেয়ার আগে…মুসলিমদের আবারও
একত্রে জীবন্ত দগ্ধকরণের
আগে।প্রতিবাদ এর
দিকে অগ্রসর হোন! সার্বজনীন
প্রতিরোধ এ যোগ দিন!
আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আপনাদের
সাহায্য করবেন। আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া
তা’আলা) আপনাদের সাহস যোগাবেন!
আপনারা যদি এই পথ বেছে নেন,
আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আপনাদের
কারণে এই জাতিকে সম্মানিত করবেন।
আর সকল প্রশংসা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া
তা’আলার। যিনি বলেনঃ
ﻭَﻟَﻮْﻟَﺎ ﺩَﻓْﻊُ ﺍﻟﻠّٰﻪِ ﺍﻟﻨَّﺎﺱَ ﺑَﻌْﻀَﻬُﻢْ ﺑِﺒَﻌْﺾٍ
ﻟَّﻔَﺴَﺪَﺕِ ﺍﻟْﺎَﺭْﺽُ ﻭَﻟٰﻜِﻦَّ ﺍﻟﻠّٰﻪَ ﺫُﻭْ ﻓَﻀْﻞٍ ﻋَﻠَﻲ
ﺍﻟْﻌٰﻠَﻤِﻴْﻦَ ٢٥١؁
“(আসলে) আল্লাহ তা’আলা যদি (যুগে
যুগে) একদল লোককে দিয়ে
আরেকদল লোককে শায়েস্তা না
করতেন, তাহলে এই ভূখণ্ড ফিতনা
ফাসাদে ভরে যেতো, (কিন্তু আল্লাহ
তা’আলা তা চাননি, কেননা) আল্লাহ তা’আলা
এ সৃষ্টিকুলের প্রতি বড়োই
অনুগ্রহশীল!” [সুরাঃ আল-বাকারা; আয়াতঃ
২৫১)

প্রগতিবাদের অস্ত্র

কয়েক বছর পূর্বেকার একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল,যা সমুদ্র-সৈকতে দৃষ্টিগোচর হয়েছিল। একটি যুবতী মেয়ে বালুর উপর বসে আলোকচিত্রী শিল্পীকে (বয়ফ্রেন্ড্ও হতে পারে) দিয়ে নিজের ছবি উঠাচ্ছিল। তার পরিধানে ছিল সামান্যতম পোষাক। নিজের অবশিষ্ট সামান্যতম লজ্জার কারণে সে দুই হাঁটু একত্র করে বসেছিল। ফটোগ্রাফার যেহেতু প্রগতিবাদী যুবক ছিল, তাই সে প্রগতিশীল পোজ নিতে চাচ্ছিল । সে যুবতীর নিকটে গিয়ে তার হাঁটুদ্বয় ফাঁক করতে চাইল। কিন্তু সে নিজের অবশিষ্ট লজ্জার কারণে তাতে রাজি হচ্ছিল না। এ অবস্থা দেখে ফটোগ্রাফার চিত্কার করে বলল, হায়, আমার মনে হয় তুমি গেঁয়ো ! তা না হলে তুমি আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে পারতে না।
একথা শুনা মাত্র মেয়েটির চোখ, নাক-মুখ ও দেহে যে লজ্জাটুকু অবশিষ্ট ছিল তাও কর্পূরের মতো উবে গেল। নির্দ্বিধায় নিজের হাঁটুদ্বয় ফাঁক করে দিয়ে একটি সুন্দর (?) প্রগতিশীল ছবির পোজ দেয়ার জন্য সে প্রস্তুত হয়ে গেল ।

নৈরাজ্যসৃষ্টি কল্পে শয়তানের এজেন্টরা এ জাতীয় সম্বোধন ও খেতাব দিয়ে মানুষের দুর্বল করে পঙ্কিলতার ভিতরে টেনে নেয়। মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে এ জাতীয় নেতিবাচক শব্দ গুলো মারণাস্ত্রের মতোই কার্যকর-প্রগতিবাদীরা এ কথা খুব ভাল করে জানে।
মুসলিম প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধেও তারা এ অস্ত্র প্রয়োগ করছে। পশ্চাত্পদ ,বর্বর, সেকেলে, প্রতিক্রিয়াশীল, মৌলবাদী, জঙ্গি-সন্ত্রাসী, সাম্প্রদায়িক ইত্যাকার শব্দ মিসাইলের মোকাবিলায় ঈমান ও জ্ঞানের দিক থেকে দুর্বল ও নিঃস্ব মুসলমানদের প্রতিরোধ শক্তি দমে যায় এবং তাদের মধ্যে হীনমন্যতাবোধ সৃষ্টি হয়। এভাবে আধুনিক জাহিলিয়াতের নিশান বরদাররা মুসলমানদের জ্ঞানবুদ্ধি , চিন্তা-চেতনা ও যোগ্যতাকে হরণ করে নেয়। এভাবেই ইসলামি সভ্যতা-সংস্কৃতির বসতভৃমি পাশ্চাত্য তথা খ্রিস্ট-ইহুদিদের মানবতা বিধ্বংসী সভ্যতা-সংস্কৃতির লীলাভূমিতে পরিণত হয়।

প্রগতির নামে প্রহসন : আধুনিকতার নামে ইসলাম বিসর্জন

সারা বিশ্বে প্রগতির লু হাওয়া প্রবাহিত হচ্ছে। সকলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য একই। প্রগতিশীল সমাজবিজ্ঞানীদের ধারনা আমাদের সমাজটা পরিবর্তন করা উচিৎ। সেকেলের সমাজ ব্যবস্থায় সার্বিক অধিকার প্রতিষ্ঠা অসম্ভব, বিধায় প্রগতিশীল সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে তা পরিবর্তন করা সমীচীন। প্রগতির উল্টোটা প্রতিক্রিয়া। আর প্রতিক্রিয়া সেই দর্শন বা মতবাদ যা মনে করে মানুষের ইতিহাস ক্রমে অবনতিশীল। মানুষ ও সভ্যতা ক্রমেই অবক্ষয়ের দিকে ধাবি ত হচ্ছে। কেউ চিন্তা করেন, মুলত প্রগতির ধারণা মনে করে বর্তমান অতীতের চেয়ে শ্রেয় এবং বিশ্বাস করে যে ভবিষ্যৎ আরো ভালো হতে পারে এবং হবে। পক্ষান্তরে কেউ চিন্তা করেন, প্রাচীন যুগ আধুনিক যুগের চাইতে শ্রেয়, অর্থাৎ সময় যত গড়িয়ে যাচ্ছে মানুষের অবস্থার তত অবনতি ঘটছে। আধুনিক যুগে মানুষের পার্থিব ও মানসিক অগ্রগতি ঘটেছে বটে কিন্তু মানবিক মূল্যবোধ, সামাজিক বন্ধন, সহমর্মিতা, পারিবারিক সুসম্পর্ক সহ যাবতীয় প্রণয়ের বন্ধন ছিন্ন করে মানবতার অবনতি ঘটেছে।
প্রগতি ইংরেজি Progress শব্দটি, ল্যাটিন শব্দ Prograde থেকে উদ্ভূত। যার অর্থ অগ্রগতি, উৎকর্ষতা, জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতি, সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া ইত্যাদি। প্রগতির আভিধানিক অর্থের মতামত সকলের কাছে প্রায় একই। তবে পারিভাষিক অর্থে যত মতানৈক্য পরিলক্ষিত হয়। এই মতপার্থক্য মূলত আদর্শিকভাবে হয়েছে। তাই প্রগতি বলতে বোঝায় এমন একটি নির্দিষ্ট উচ্চ বা শ্রেয় লক্ষ্যের অভিমুখে অগ্রসর হওয়াকে। আবার বর্তমান প্রগতিশীল ব্যক্তিগণের বক্তব্য হলো: প্রগতি মানেই সকল ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন। ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্মীয় সহ যাবতীয় বিষয়ে অগ্রগতি প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর।
তথাকথিত আধুনিক ধ্বজাধারী প্রগতিশীলরা মনে করেন, এই প্রগতির ছোঁয়া লাগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উত্তরণের লক্ষ্যে শিল্পবিপ্লবের সময় থেকে। সত্তর দশকে প্রগতির ধারণাকে উজ্জীবিত করেছে আধুনিক বিজ্ঞানের জয়যাত্রা। বিজ্ঞানের জয়যাত্রার সাথে সাথে শিল্পবিপ্লব ইউরোপে অর্থনৈতিক অগ্রগতি প্রগতির ধারণাকে আরো জনপ্রিয় করে তোলে। সামাজিক বিবর্তনের ধারণা সামাজিক প্রগতির সঙ্গে জড়িত ও সংযুক্ত। আবার সামাজিক প্রগতির ধারণা ইতিবাচক দর্শনের সঙ্গেই যুক্ত। অগাস্ট কোঁত সামাজিক প্রগতিকে মানুষের চিন্তাধারার প্রগতির সঙ্গে সমার্থক বলে বিবেচনা করেছেন। মনোজগতে মানুষের প্রগতির মানব সমাজের প্রগতির মাপকাঠি। জার্মান দার্শনিক হেগেন বলেন, ‘আত্মোপলব্ধিই মনুষ্যত্বের অগ্রগতি প্রকাশের প্রণালী। তিনি গুরুত্ব দিতেন মানুষের ব্যক্তিগত উপলব্ধির ওপর। কালমার্কসের মতে, সমাজের একটি স্তর থেকে অন্য স্তরে পৌঁছতে উৎপাদন কৌশলের যে পরিবর্তন তাই প্রগতি। প্রগতি হলো এমন একটি সামাজিক পরিবর্তন, যা অনুপ্রাকৃতিক নিয়মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়ে মানুষের সামাজিক মূল্যবোধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আরও স্পষ্ট করে বলা যায়, প্রগতি হলো মানুষ যে সামাজিক ও নৈতিক গুণগুলোকে মূল্য দেয় সমাজের মানুষের জীবনে সে গুণগুলোর অধিকার, প্রকাশ, বিকাশ ও স্থায়ীভাবে রূপান্তরিত হওয়া। মোটকথা, প্রগতি হচ্ছে বিবর্তন ও সামাজিক পরিবর্তনের পরিচালক।
একদল সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্ক হয়েছে। রবার্ট নিসবেট মনে করেন যে, সমাজবিজ্ঞানীরা প্রগতির ধারণার জনক। আবার ঐতিহাসিক কার্ল বেকার বিশ্বাস করেন যে, প্রগতির ধারনার উদ্ভাবক হোল ইউরোপের এনলাইটেনমেন্ট আন্দোলনের লেখকরা। তাঁরা কেউ দার্শনিক ছিলেন না; কিন্তু তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, আধুনিক কালে মানুষের ইতিহাসে নব যুগের সুচনা হয়েছে এবং মানুষের সভ্যতা উত্তরোত্তর প্রগতির পথে এগিয়ে চলেছে। প্রথমদিকে অনেক সমাজবিজ্ঞানী এ মতবাদের বিরোধিতা করেছেন, তবে পরবর্তীকালে সমাজবিজ্ঞানীরাই প্রগতির সবচেয়ে বড় প্রবক্তা হয়ে দাঁড়ান।
সারা পৃথিবীর মুসলমানদেরকে প্রগতির নামে সুকৌশলে বস্তুবাদী, পূঁজিবাদী সূদী অর্থনীতি চালু ও ধর্মনিরোপেক্ষতাবাদ প্রচার করে চলেছে। প্রগতি ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ও সম্পূরক আদর্শ মাত্র। অথচ ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ একটি নিরেট কুফরী মতবাদ। ইসলামের সাথে এর আপোষ করার কোন সুযোগ নেই। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ মানুষকে ইসলামী আদর্শ থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে।
ইনসাইক্লোপেডিয়া বৃটানিকাতে সেক্যুলারিজমের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, Any movement in society directed away from other worldliness to life on Earth… ‘এটি এমন একটি সামাজিক আন্দোলনের নাম, যা মানুষকে আখেরাতের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে কেবলমাত্র পার্থিব বিষয়ের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করায়’। অর্থাৎ ধর্মীয় গোড়ামীকে উপেক্ষা করে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ প্রতিষ্ঠা, নারী-পুরুষ সমাধিকার, ধর্মকে পিছনে ফেলে বিজ্ঞানের উৎকর্ষতাকে পরিগ্রহণ ইত্যাদি। বস্তুতঃ ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ প্রথমে মুসলমানকে তাওহীদের গন্ডীমুক্ত করে তাগুতের পথে পরিচালিত করে। কিন্তু কেন? ইসলাম কি প্রগতির অন্তায়? না, ইসলাম কখনোই প্রগতির অন্তরায় নয়। আমাদের যদি সুস্থ চিন্তা চেতনা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ থাকে তবে আমরাই প্রগতিশীল আর যদি নিচু ও অসুস্থ মন-মানসিকতা থাকে তবে আমরা প্রগতির নামে অপব্যাখ্যা করে প্রহসনে নিমগ্ন। ইসলাম প্রগতির অন্তরায় না, বরং ইসলামের অপব্যাখ্যা ও ধর্ম বিবর্জিত জীবনই প্রগতির অন্তরায়।
যারা ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদকে উপেক্ষা করেন তারা মনে করেন প্রগতি হলো, ১৪০০ বছর পূর্বের সেই আইয়্যামে জাহিলিয়াতের তমাচ্ছন্ন ঘোর অন্ধকার থেকে উত্তরণের নাম। এই সংজ্ঞা মতে, ধর্মনিরপেক্ষতাকে উপেক্ষা করে ধর্মীয় অনুশাসনের মাধ্যমে যাবতীয় সংকীর্ণতা পিছনে ফেলে হযরত মুহাম্মাদ (ছা:) এর প্রদর্শিত আদর্শর অগ্রগতিকেই প্রগতি বলে, যা চিরন্তন ও সার্বজনীন। আদি পিতা হযরত আদম (আ:) দ্বীন ইসলামের প্রথম বাহক। যুগে যুগে প্রয়োজন বোধে মহান আল্লাহ্ দ্বীন ইসলামকে প্রগতিশীল করার উদ্দেশ্যে মানব জাতির মধ্য থেকে নবী-রাসূল নির্বাচিত করে দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন। সর্বশেষ হযরত মুহাম্মাদ (ছা:) এর মাধ্যমে প্রগতির চিরন্তন ও সার্বজনীন ভিত্তি স্থাপন করেছেন। যা শাশ্বত অপরিবর্তীত। আর ইসলামের অনুশীলনের মাধ্যমে রাসূল (ছা:) অন্ধকারাচ্ছন্ন জাহেলী যুগকে প্রগতিশীল স্বর্ণযুগে পরিণত করেছিলেন। সেই যুগের মানুষই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। তারা ইসলামের বিধিবিধান অনুসরণ করেই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিলেন। এসম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ﻛُﻨْﺘُﻢْ ﺧَﻴْﺮَ ﺃُﻣَّﺔٍ ﺃُﺧْﺮِﺟَﺖْ ﻟِﻠﻨَّﺎﺱِ – ‘তোমরাই হ’লে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে’ (আলে ইমরান ৩/১১০)। নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, ﺧَﻴْﺮُ ﺍﻟﻨَّﺎﺱِ ﻗَﺮْﻧِﻲْ ﺛُﻢَّ ﺍﻟَّﺬِﻳْﻦَ ﻳَﻠُﻮْﻧَﻬُﻢْ ﺛُﻢَّ ﺍﻟَّﺬِﻳْﻦَ ﻳَﻠُﻮْﻧَﻬُﻢْ- ‘আমার যুগের মানুষই সর্বোত্তম মানুষ। অতঃপর তার পরের যুগের মানুষ, অতঃপর তার পরের যুগের মানুষ’। (বুখারী, হা/২৬৫২; মুসলিম, হা/২৫৩৩)।
তাছাড়া তখন যেসকল দেশে ইসলামী আইনের অনুশাসন বিদ্যমান ছিল ঐ সকল দেশ প্রগতীর মাধ্যমে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিল। এখনো যেসব দেশে ইসলামের অনুশাসন যত বেশী সেই সব দেশ তত উন্নত, সভ্য ও প্রগতির উচ্চ শিখরে অবস্থান করছে। যদি আমরা ইসলামী অনুশাসনের আদলে ইসলামী প্রগতিশীল হয় তবে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত নাযিল করা হবে এবং প্রবৃদ্ধিতে দেশকে সমৃদ্ধ করা হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ﻭَﻟَﻮْ ﺃَﻥَّ ﺃَﻫْﻞَ ﺍﻟْﻘُﺮَﻯ ﺁﻣَﻨُﻮﺍ ﻭَﺍﺗَّﻘَﻮْﺍ ﻟَﻔَﺘَﺤْﻨَﺎ ﻋَﻠَﻴْﻬِﻢْ ﺑَﺮَﻛَﺎﺕٍ ﻣِﻦَ ﺍﻟﺴَّﻤَﺎﺀِ ﻭَﺍﻟْﺄَﺭْﺽِ ﻭَﻟَﻜِﻦْ ﻛَﺬَّﺑُﻮﺍ ﻓَﺄَﺧَﺬْﻧَﺎﻫُﻢْ ﺑِﻤَﺎ ﻛَﺎﻧُﻮﺍ ﻳَﻜْﺴِﺒُﻮﻥَ ‘জনপদের অধিবাসীরা যদি ঈমান আনয়ন করে এবং আল্লাহভীতি অর্জন করে, তবে তাদের প্রতি আসমান-যমীনের যাবতীয় বরকতের পথ উন্মুক্ত করে দিব’ (আ‘রাফ ৯৬)।
আমাদের সমাজে এক শ্রেণির কিছু মানুষ আছে যারা ইসলামকে চিরন্তন প্রগতিশীল মনে করেন, তবে ইসলামের যোজন-বিয়োজনের প্রয়োজনও অনুভব করেন। আর তা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের ভুল অর্থ ও অপব্যাখ্যার মাধ্যমে কিয়াস করে থাকেন। আবার তারা বিজাতীয় মতবাদবে সরাসরি গ্রহণ না করে ঘুরিয়ে তা গ্রহণ করেন। তাদের মতে যুগের সাথে বা সামাজিকতার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। অথচ দ্বীন ইসলামকে মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য মনোনীত করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ﺇِﻥَّ ﺍﻟﺪِّﻳْﻦَ ﻋِﻨْﺪَ ﺍﻟﻠﻪِ ﺍﻟْﺈِﺳْﻼَﻡُ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্র নিকট মনোনীত দ্বীন হচ্ছে ইসলাম’ (আলে-ইমরান ৩/১৯)। আর এই দ্বীনের মধ্যে কোন প্রকার রদ বদল বা যোজন-বিয়োজন করা প্রশ্নই আসে না। দ্বীন ইসলাম চিরস্থায়ী পূর্ণাঙ্গ ও সংযোজন-বিয়োজন মুক্ত সার্বজনীন প্রগতিশীল। এসম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ﺍَﻟْﻴَﻮْﻡَ ﺃَﻛْﻤَﻠْﺖُ ﻟَﻜُﻢْ ﺩِﻳْﻨَﻜُﻢْ ﻭَﺃَﺗْﻤَﻤْﺖُ ﻋَﻠَﻴْﻜُﻢْ ﻧِﻌْﻤَﺘِﻲْ ﻭَﺭَﺿِﻴْﺖُ ﻟَﻜُﻢُ ﺍﻟْﺈِﺳْﻼَﻡَ ﺩِﻳْﻨًﺎ – ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার নে‘মত পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম’ (মায়েদাহ ৫/৩)।

নারীবাদীরা কেন পতিতাবৃত্তির পক্ষে ?

সুপ্রীতি ধর নামক এক এক্সট্রিমিস্ট হিন্দুর সম্পদনায় পরিচালিত ওয়েম্যানচাপ্টার পত্রিকায় দীর্ঘদিন ধরে পতিতবৃত্তিকে প্রমোট করে লেখা হচ্ছে। সর্বশেষ ‘এই শহরে যৌনপল্লী দরদার’ শিরোনামে একটা লেখা ছাপা হয়।
লেখার সারমর্ম, লেখিকা রাস্তায় যাওয়ার সময় কোন এক পুরুষ তার পেছন পেছন “রেট কতো, রেট কতো” বলে চিৎকার করে। এতে লেখিকা বিরক্ত হয়। এক পর্যায়ে সে অনুধাবন করে রেট কতো শব্দদুখানা উচ্চারণ করা ব্যক্তিটি একজন নির্মাণ শ্রমিক। এতে সে বুঝতে সক্ষম হয়, ঢাকা শহরে নিম্নবিত্ত শ্রেণীর যৌনতা প্রাপ্তির সংকট হচ্ছে। এরপর রাস্তায় পরে থাকা ব্যবহৃত কনডম দেখেও তার একই দর্শন অনুধাবন হয়। এরপর তার বক্তব্য, রাস্তায় অনেক ভাসমান পতিতাকে সে খদ্দেরের সাথে দরদাম করতে দেখেছে। সর্বশেষ তার বক্তব্য- যেহেতু এক শ্রেণীর লোকের যৌনতার প্রয়োজন হচ্ছে, কিন্তু ফ্লাটের সামর্থ নাই। আবার আরেক শ্রেনীর নারীরও খদ্দের প্রয়োজন আছে, তাই ঢাকা শহরে কিছু পতিতাপল্লী তৈরী করে দিলেই সমস্যা চুকে যায়। (https://womenchapter.com/views/21417)

আমি লেখিকার যুক্তিতর্ক খণ্ডনে যাবো না। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, নারীবাদী পত্রিকাগুলো কেন পতিতাবৃত্তি পেশার পক্ষে ? এর পেছনে কি কারণ থাকতে পারে ??

বাস্তবে আমরা জানি,
পতিতাবৃত্তি হচ্ছে নারীর জন্য চরম এক অপমানজক বিষয়। নারীকে পন্যবস্তুর মত পুরুষের দ্বারা গণভোগ করা। পতিতাদের সাক্ষাৎকার শুনলে বোঝা যায়, তারা ভয়ঙ্কর ও অনিরাপদ জীবন-যাপন করে, কত নৃশংস উপায়ে নির্যাতিত হয়। তবু কেন নারীবাদীরা পতিতাবৃত্তির পক্ষে বলে ??

এর অনেক কারণ থাকতে পারে। একটি হতে পারে, নারীবাদীরা অধিকাংশ ঐ পেশাভূক্ত নারী অথবা কোন এক সময় এ পেশায় সময় দিয়েছে । এরা লেজকাটা শেয়ালের মত, তারা চায় নারীরাও তাদের মত লেজকেটে ফেলুক। এ কারণেই তারা পতিতাবৃত্তির বিস্তার চায়।

এর উদাহরণে বলা যায়, গত ২০১৫ সালের ৫ই মে তারিখে বিশিষ্ট নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিন স্ট্যাটাসে বলেছিলো-
“মেয়েটার চরিত্র খারাপ। তার মানে মেয়েটার কোনও পুরুষের সঙ্গে, যে পুরুষ তার স্বামী নয়, সেক্স হচ্ছে। এই হলো আমাদের সমাজের ‘চরিত্র খারাপ’-এর সংজ্ঞা। ছেলেদের বেলায়ও বলা হয় চরিত্র খারাপ, ছেলেদের যদি প্রচুর মেয়ে টেয়ে নিয়ে সেক্স করার অভ্যেস থাকে। সেক্সের মতো স্বাভাবিক, সুস্বাদু এবং প্রয়োজনীয় জিনিস চরিত্র খারাপের উদাহরণ হিসেবে কী করে আসে, বুঝিনা। যদি বলা হয়, এমন সমাজই আমরা তৈরি করেছি, যে সমাজে স্বামী- স্ত্রীর সঙ্গমটাই বৈধ সঙ্গম, বাকি সব অবৈধ, তবে বলবো, সমাজ আমরাই তৈরি করি, সমাজ আমরাই ভাঙি। সমাজের পুরোনো নিয়ম-নীতি তো আমরা ভাঙতে ভাঙতেই এগোই। পুরোনো অনেক নিয়ম, যা না মানলে বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড হতো একসময়, এখন মানলেই বরং তা হয়। আমার মতে একটা মানুষের, পুরুষ বা নারী উভয়ের ক্ষেত্রেই, চরিত্র খারাপ মানে, মানুষটা লোভী, চুরি করে, মিথ্যে কথা বলে, ডাকাতি করে, অন্যকে ঠকায়, অন্যের সঙ্গে প্রতারণা করে, দূর্নীতি করে, নিষ্ঠুরতা করে, মানুষ খুন করে। ‘চরিত্র খারাপ’ এর প্রচলিত সংজ্ঞাটা অচিরে বদলানো দরকার।” (http://archive.is/GrAdn)

আরেকটি কারণ হতে পারে,
নারীবাদীরা চায় সমাজে পারিবারিক বন্ধনগুলো ভেঙ্গে যাক। আর পারিবারিক বন্ধন ভাঙ্গার সাথে সমাজে পতিতালয় বৃদ্ধির সঙ্গে একটা সমানুপাতিক সম্পর্ক আছে। এ সম্পর্কে কলকাতার মুভি ‘রাতের রজনীগন্ধা’য় এক পতিতার (চরিত্র: কমলিকা ব্যানার্জি) একটা ডায়লগ ছিলো- “ঐ শালারাই (খদ্দের) তো আমাদের লক্ষী, বুঝলি। ওদের জন্যই তো আমাদের খাবার জোটে। আমি তো প্রতিদিন ভগবানকে বলি- ভগবান ! ভদ্রলোকেদের (কলকাতার হিন্দু খদ্দের) ঘরে আরেকটু অশান্তি বাড়াও। ভদ্রঘরের বউরা যত অশান্তি বাড়াবে, আমাদের আয় তত বাড়বে।”

আরেকটা কারণ থাকতে পারে-
ধর্মের বিরুদ্ধচারণ। ধর্মে বলা আছে- নারী যেন বহুগামী না হয়। এর একটি কারণ- নারী বহুগামী হলে সন্তানের প্রকৃতপিতা খুজে পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু নারীবাদীরা চায় নারীরা যেন এক পুরুষের সীমানা থেকে বের হয়ে বহুগামী হয়। আর সমাজে বহুগামী নারীর একমাত্র প্রকৃষ্ট উদহারণ হলো পতিতারা। হয়ত বহুগামী নারীর দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতেই নারীবাদীদের পতিতাবৃত্তির পক্ষ অবলম্বন।

পতিতাবৃত্তির সামাজিক ফলাফল কখনই ভালো না। পারিবারিক বন্ধন নষ্ট, দূরারোগ্য রোগ বৃদ্ধি, জারজ প্রজন্ম বেড়ে যাওয়া, সমাজিক ভারসাম্য ধ্বংস, পরকীয়া, নারী পাচার-বাণিজ্য, শিশু নিপীড়ন-ধর্ষণ, সমাজে অরাজকতা বৃদ্ধি, নারীর চরম অপমানসহ এমন কোন সমস্যা নেই যা পতিতাবৃত্তি থেকে সৃষ্টি হয় না। তারপরও যখন নারীবাদীরা পতিতাবৃত্তির পক্ষে বলে তখন স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন উঠে, “আচ্ছা! নারীবাদীরা কি সত্যিই সমাজের ভালো চায় ?”

১৯৪৭-এ ভারতের জম্মুর মুসলিম গণহত্যা যা ইতিহাসের এক বিস্মৃত অধ্যায়

১৯৪৭ এর ভারতের জম্মুর মুসলিম গণহত্যাঃ যা ইতিহাসের এক বিস্মৃত অধ্যায়
জম্মু ও কাশ্মীর, পাশাপাশি দুটো আলাদা এলাকা। কাশ্মীর মুসলিমপ্রধান, জম্মু হিন্দুপ্রধান। ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসের আগে জম্মু মুসলিমপ্রধান অঞ্চলই ছিলো, কিন্তু ঐ এক মাসের মধ্যেই মুসলিম গণহত্যা চালিয়ে জম্মুকে হিন্দুপ্রধান অঞ্চলে পরিণত করা হয় ।

১০ই আগস্ট ১৯৪৮ এ লন্ডনের টাইমস পত্রিকায় এই গণহত্যা নিয়ে ছাপা হয়েছিলঃ ২ লক্ষ ৩৭ হাজার মুসলমানকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়, সেইসব মুসলমান ব্যতীত যারা সীমানা দিয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। এই গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিলো কাশ্মীরে ব্রিটিশ নিয়োজিত রাজা হরি সিং এর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ডোগরা সেনাবাহিনীর দ্বারা। ডোগরা সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করেছিল আরএসএসের হিন্দু এবং শিখেরা।

১৯৪৭ এর অক্টোবরের এই গণহত্যার পাঁচদিন পরেই পাঠানরা কাশ্মীর আক্রমণ করে, নয়দিন পরেই হরি সিং ভারতে যোগদান করে। এই গণহত্যার ফলে ৬১% মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মুতে রাতারাতি মুসলমানরা ৩৫% এ নেমে আসে। ১৯৫১ সালের আদমশুমারি করতে গিয়ে এজন্য দেখা যায়, জম্মুতে গ্রামের পর গ্রাম কোন মানুষ নেই। ১২৩ টি গ্রাম সম্পূর্ণ জনমানবহীন ছিলো, জম্মুর কাঠুয়া জেলার ৫০ শতাংশ মুসলিম গায়েব হয়ে গিয়েছিল। (সূত্রঃ http://goo.gl/zRA54Q, http://goo.gl/mlVShF)

গোটা বিশ্ব এই গণহত্যা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না, কারণ ভারতীয় সরকার এই গণহত্যাকে ধামাচাপা দিতে চেষ্টার কোন কমতি রাখেনি। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় ১৯৮৯ সালের ভাগলপুর দাঙ্গার কথা। ভারতীয় ইতিহাসবিদ গোলাম আহমাদ মোর্তজা তার বইতে লিখেছেন, ঐ দাঙ্গায় লোগিয়ন নামক এক গ্রামে পুলিশের এক হিন্দু এএসআই-এর নেতৃত্বে যে গণহত্যা চলে তাতে ১০৮ জন মুসলমানকে হত্যা করে মাটি চাপা দিয়ে দেয় সন্ত্রাসী হিন্দুরা। সাথে সাথে প্রমাণ লুকাতে ওই গণকবরকে পরিণত করা হয় ফুলকপি ক্ষেতে। অমরপুর নামক এক এলাকায় মুসলমানদের হত্যা করে মাটিতে পুতে ফেলা হয় এবং গণকবরের উপর তৈরি করা হয় রসুন ক্ষেত।

এখন তথ্যপ্রযুক্তির যুগ হওয়ায় আমরা জানতে পেরেছি কাশ্মীরের মুক্তিকামী নেতা বুরহান ওয়ানীর হত্যাকাণ্ডের কথা। এই হত্যাকাণ্ডের জের ধরে আরও ৩০ জন মুসলমানকে গুলি করে শহীদ করেছে ভারতীয় হায়েনারা। (http://goo.gl/eE9S05) ফেসবুক ইন্টারনেট না থাকলে এই হত্যাকাণ্ডের খবর ৪৭-এর জম্মু হত্যাকাণ্ডের মতোই ধামাচাপা পড়ে যেতো, ফুলকপি বা রসুনক্ষেত তৈরী করে মুসলমানদের লাশগুলো ঢেকে দিতো ঠাণ্ডা মাথার হিন্দু খুনীরা।

এসব ইতিহাস পড়েও মুসলমানরা শিশুর মতোই আলাভোলা থেকে যায়, কিছুতেই হিন্দুদের নৃশংস রূপটি তারা বোঝার চেষ্টা করে না। অনেকটা ‘লাইফ অফ পাই’ সিনেমার মূল চরিত্রটির মতো যার কাহিনী আমাকে আমার এক ফ্যান বলেছিলো, যে ছোটবেলায় না বোঝার কারণে বাঘের খাঁচার ভিতরে হাত ঢোকাতে চেষ্টা করেছিল। তার বাবা টের পাওয়ায় অল্পের জন্য সে রক্ষা পায়। (https://youtu.be/QCMPzZXNjUQ)

তার চিড়িয়াখানার তত্ত্বাবধায়ক বাবা পরে ছেলেকে শিক্ষা দেয়ার জন্য জন্য বাঘের খাঁচার গ্রীলে একটা ছাগল বেঁধে রাখে। বাঘ তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে দৌড়ে এসে ছাগলটিকে থাবা দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে, বাচ্চাটি এই নির্মম দৃশ্য দেখে তার মায়ের কোলে মাথা লুকায়। (https://youtu.be/ghxNSQpj6pM)

বর্তমান মুসলমানদের দেখলেও আমার ঐ মায়ের কোলে মাথা লুকানো নাবালক ছেলেটির কথাই মনে হয়। এদেরকে যতোই বোঝান না কেন, হিন্দুরা তোমার শত্রু, তারা ততোই মাথা লুকিয়ে বাচ্চামানুষের মতো বলতে থাকে, যান যান বেশি সাম্প্রদায়িকতা দেখাবেন না। তবে অচিরেই বাঙালি মুসলমানদের এই ইম্যাচিউরিটি ও ছেলেমানুষির অবসান ঘটবে, যখন হিন্দুপ্রীতির খেসারত দিতে গিয়ে তাদেরকেও সিরিয়ার মুসলমানদের মতো উদ্ধাস্তু হয়ে সাগরে ভাসতে হবে।

মুসলমানের উপর হিন্দু জমিদারের নির্মম অত্যাচার কি মুসলমান ভুলে গেছে?

হিন্দু জমিদারেরা আদেশ করেছিল –
১। যারা দাড়ি রাখবে, গোঁফ ছাঁটবে তাদেরকে ফি দাড়ির জন্যে আড়াই টাকা ও ফি গোঁফের জন্যে পাঁচ সিকা করে খাজনা দিতে হবে
২। মসজিদ তৈরী করলে প্রথ্যেক কাঁচা মসজিদের জন্যে পাঁচশ’ টাকা এবং প্রতি পাকা মসজিদের জন্যে এক হাজার টাকা করে জমিদার সরকারে নজন দিতে হবে।
৩। বাপদাদা সন্তানদের যে নাম রাখবে তা পরিবর্তন করে আরবী নাম রাখলে প্রত্যেক নামের জন্যে খারিজানা ফিস পঞ্চাম টাকা জমিদার সরকারে জমা দিতে হবে।
৪। গোহত্যা করলে তার ডান হাত কেটে দেয়া হবে –যাতে আর কোনদিন গোহত্যা করতে না পারে।
৫। যে তিতুমীরকে বাড়ীতে স্থান দিবে তাকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা হবে।
(শহীদ তিতুমীর –আবদুল গফুর সিদ্দিকী পৃঃ ৪৮, ৪৯; স্বাধীনতা সংগ্রাসের ইতিহাস, আবু জাফর পৃঃ ১১৯; Bengal Criminal Judicial Consultation, 3 April 1832, No. 5 and 6)।
মুসলমান প্রজাদের উপরে উপরোক্ত ধরনের জরিমানা ও উৎপীড়নের ব্যাপারে তারাগুনিয়ার জমিদার রাম নারায়ণ, কুরগাছির জমিদারের নায়েব নাগরপুর নিবাসী গৌড় প্রসাদ চৌধুরী এবং পুঁড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের নাম পাওয়া যায় –Bengal Criminal Judicial Consultancy, 3 April 1832, No.5 রেকর্ডে। (Dr. AR Mallick, British Policy & the Muslims in Bengal, p.76)।
বারাসাতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে জমিদার রাম নারায়ণের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল যাতে জনৈক সাক্ষী একথা বলে যে –উক্ত জমিদার দাড়ি রাখার জন্যে তার পঁচিশ টাকা জরিমানা করে এবং দাড়ি উপড়ে ফেলার আদেশ দেয়। Bengal Criminal Judicial Consultancy, 3 April 1832, No.5; (Dr. AR Mallick, British Policy & the Muslims in Bengal, p.76)।
তিতুমীর কৃষ্ণদেব রায়কে একখানা পত্রের মাধ্যমে জানিয়ে দেন যে, তিনি কোন অন্যায় কাজ করেননি, মুসলমানদের মধ্যে ইসলাম প্রচারের কাজ করছেন। এ কাজে হস্তক্ষেপ করা কোনক্রমেই ন্যায়সঙ্গত হতে পারে না। নামাজ পড়া, রোজা রাখা, দাড়ি রাখা, গোঁফ ছাঁটা প্রভৃতি মুসলমানের জন্যে ধর্মীয় নির্দেশ। এ কাজে বাধা দান করা অপর ধর্মে হস্তক্ষেপেরই শামিল।
পত্রবাহক বল্লো, হুজুর আমার নাম আমিনুল্লাহ, বাপের নাম কামালউদ্দীন, লোকে আমাদেরকে আমন-কামন বলে ডাকে। আর দাড়ি রাখা আমাদের ধর্মের আদেশ। তাই পালন করেছি।
কৃষ্ণদেব রাগে থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে বললো, ব্যাটা দাড়ির খাজান দিয়েছিস, নাম বদলের খাজনা দিয়েছিস? আচ্ছা, দেখাচ্ছি মজা। ব্যাটা আমার সাথে তর্ক করিস, এত বড়ো তোর স্পর্ধা? এই বলে মুচিরামের উপর আদেশ হলো তাকে গারদে বন্ধ করে উচিত শাস্তির। বলা বাহুল্য, অমানুষিক অত্যাচার ও প্রহারের ফলে তিতুমীরের ইসলামী আন্দোলনের প্রথম শহীদ হলো আমিনুল্লাহ। সংবাদটি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। মুসলমানরা মর্মাহত হলো, কিন্তু সাক্ষী প্রমাণের অভাবে প্রবল শক্তিশালী জমিদারের বিরুদ্ধে কিছুই করতে না পেরে তারা নীরব রইলো।
আফসোস মুসলমান নিজের ইতিহাস ভুলে গেছে। তারা ভুলে গেছে হিন্দু জমিদারেরা কি অমানবিক নির্যাতন করেছিল মুসলমানের উপর। আজ মুসলমান তার পুর্ব পুরুষের উপর হিন্দুদের অত্যচারের কথা ভুলে তাদের ভাই বলে যারা কাছে টেনে নেয় তাদের মত গাদ্দার আর কেউ হতে পারে?