প্রগতির নামে প্রহসন : আধুনিকতার নামে ইসলাম বিসর্জন

সারা বিশ্বে প্রগতির লু হাওয়া প্রবাহিত হচ্ছে। সকলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য একই। প্রগতিশীল সমাজবিজ্ঞানীদের ধারনা আমাদের সমাজটা পরিবর্তন করা উচিৎ। সেকেলের সমাজ ব্যবস্থায় সার্বিক অধিকার প্রতিষ্ঠা অসম্ভব, বিধায় প্রগতিশীল সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে তা পরিবর্তন করা সমীচীন। প্রগতির উল্টোটা প্রতিক্রিয়া। আর প্রতিক্রিয়া সেই দর্শন বা মতবাদ যা মনে করে মানুষের ইতিহাস ক্রমে অবনতিশীল। মানুষ ও সভ্যতা ক্রমেই অবক্ষয়ের দিকে ধাবি ত হচ্ছে। কেউ চিন্তা করেন, মুলত প্রগতির ধারণা মনে করে বর্তমান অতীতের চেয়ে শ্রেয় এবং বিশ্বাস করে যে ভবিষ্যৎ আরো ভালো হতে পারে এবং হবে। পক্ষান্তরে কেউ চিন্তা করেন, প্রাচীন যুগ আধুনিক যুগের চাইতে শ্রেয়, অর্থাৎ সময় যত গড়িয়ে যাচ্ছে মানুষের অবস্থার তত অবনতি ঘটছে। আধুনিক যুগে মানুষের পার্থিব ও মানসিক অগ্রগতি ঘটেছে বটে কিন্তু মানবিক মূল্যবোধ, সামাজিক বন্ধন, সহমর্মিতা, পারিবারিক সুসম্পর্ক সহ যাবতীয় প্রণয়ের বন্ধন ছিন্ন করে মানবতার অবনতি ঘটেছে।
প্রগতি ইংরেজি Progress শব্দটি, ল্যাটিন শব্দ Prograde থেকে উদ্ভূত। যার অর্থ অগ্রগতি, উৎকর্ষতা, জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতি, সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া ইত্যাদি। প্রগতির আভিধানিক অর্থের মতামত সকলের কাছে প্রায় একই। তবে পারিভাষিক অর্থে যত মতানৈক্য পরিলক্ষিত হয়। এই মতপার্থক্য মূলত আদর্শিকভাবে হয়েছে। তাই প্রগতি বলতে বোঝায় এমন একটি নির্দিষ্ট উচ্চ বা শ্রেয় লক্ষ্যের অভিমুখে অগ্রসর হওয়াকে। আবার বর্তমান প্রগতিশীল ব্যক্তিগণের বক্তব্য হলো: প্রগতি মানেই সকল ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন। ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্মীয় সহ যাবতীয় বিষয়ে অগ্রগতি প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর।
তথাকথিত আধুনিক ধ্বজাধারী প্রগতিশীলরা মনে করেন, এই প্রগতির ছোঁয়া লাগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উত্তরণের লক্ষ্যে শিল্পবিপ্লবের সময় থেকে। সত্তর দশকে প্রগতির ধারণাকে উজ্জীবিত করেছে আধুনিক বিজ্ঞানের জয়যাত্রা। বিজ্ঞানের জয়যাত্রার সাথে সাথে শিল্পবিপ্লব ইউরোপে অর্থনৈতিক অগ্রগতি প্রগতির ধারণাকে আরো জনপ্রিয় করে তোলে। সামাজিক বিবর্তনের ধারণা সামাজিক প্রগতির সঙ্গে জড়িত ও সংযুক্ত। আবার সামাজিক প্রগতির ধারণা ইতিবাচক দর্শনের সঙ্গেই যুক্ত। অগাস্ট কোঁত সামাজিক প্রগতিকে মানুষের চিন্তাধারার প্রগতির সঙ্গে সমার্থক বলে বিবেচনা করেছেন। মনোজগতে মানুষের প্রগতির মানব সমাজের প্রগতির মাপকাঠি। জার্মান দার্শনিক হেগেন বলেন, ‘আত্মোপলব্ধিই মনুষ্যত্বের অগ্রগতি প্রকাশের প্রণালী। তিনি গুরুত্ব দিতেন মানুষের ব্যক্তিগত উপলব্ধির ওপর। কালমার্কসের মতে, সমাজের একটি স্তর থেকে অন্য স্তরে পৌঁছতে উৎপাদন কৌশলের যে পরিবর্তন তাই প্রগতি। প্রগতি হলো এমন একটি সামাজিক পরিবর্তন, যা অনুপ্রাকৃতিক নিয়মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়ে মানুষের সামাজিক মূল্যবোধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আরও স্পষ্ট করে বলা যায়, প্রগতি হলো মানুষ যে সামাজিক ও নৈতিক গুণগুলোকে মূল্য দেয় সমাজের মানুষের জীবনে সে গুণগুলোর অধিকার, প্রকাশ, বিকাশ ও স্থায়ীভাবে রূপান্তরিত হওয়া। মোটকথা, প্রগতি হচ্ছে বিবর্তন ও সামাজিক পরিবর্তনের পরিচালক।
একদল সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্ক হয়েছে। রবার্ট নিসবেট মনে করেন যে, সমাজবিজ্ঞানীরা প্রগতির ধারণার জনক। আবার ঐতিহাসিক কার্ল বেকার বিশ্বাস করেন যে, প্রগতির ধারনার উদ্ভাবক হোল ইউরোপের এনলাইটেনমেন্ট আন্দোলনের লেখকরা। তাঁরা কেউ দার্শনিক ছিলেন না; কিন্তু তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, আধুনিক কালে মানুষের ইতিহাসে নব যুগের সুচনা হয়েছে এবং মানুষের সভ্যতা উত্তরোত্তর প্রগতির পথে এগিয়ে চলেছে। প্রথমদিকে অনেক সমাজবিজ্ঞানী এ মতবাদের বিরোধিতা করেছেন, তবে পরবর্তীকালে সমাজবিজ্ঞানীরাই প্রগতির সবচেয়ে বড় প্রবক্তা হয়ে দাঁড়ান।
সারা পৃথিবীর মুসলমানদেরকে প্রগতির নামে সুকৌশলে বস্তুবাদী, পূঁজিবাদী সূদী অর্থনীতি চালু ও ধর্মনিরোপেক্ষতাবাদ প্রচার করে চলেছে। প্রগতি ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ও সম্পূরক আদর্শ মাত্র। অথচ ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ একটি নিরেট কুফরী মতবাদ। ইসলামের সাথে এর আপোষ করার কোন সুযোগ নেই। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ মানুষকে ইসলামী আদর্শ থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে।
ইনসাইক্লোপেডিয়া বৃটানিকাতে সেক্যুলারিজমের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, Any movement in society directed away from other worldliness to life on Earth… ‘এটি এমন একটি সামাজিক আন্দোলনের নাম, যা মানুষকে আখেরাতের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে কেবলমাত্র পার্থিব বিষয়ের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করায়’। অর্থাৎ ধর্মীয় গোড়ামীকে উপেক্ষা করে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ প্রতিষ্ঠা, নারী-পুরুষ সমাধিকার, ধর্মকে পিছনে ফেলে বিজ্ঞানের উৎকর্ষতাকে পরিগ্রহণ ইত্যাদি। বস্তুতঃ ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ প্রথমে মুসলমানকে তাওহীদের গন্ডীমুক্ত করে তাগুতের পথে পরিচালিত করে। কিন্তু কেন? ইসলাম কি প্রগতির অন্তায়? না, ইসলাম কখনোই প্রগতির অন্তরায় নয়। আমাদের যদি সুস্থ চিন্তা চেতনা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ থাকে তবে আমরাই প্রগতিশীল আর যদি নিচু ও অসুস্থ মন-মানসিকতা থাকে তবে আমরা প্রগতির নামে অপব্যাখ্যা করে প্রহসনে নিমগ্ন। ইসলাম প্রগতির অন্তরায় না, বরং ইসলামের অপব্যাখ্যা ও ধর্ম বিবর্জিত জীবনই প্রগতির অন্তরায়।
যারা ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদকে উপেক্ষা করেন তারা মনে করেন প্রগতি হলো, ১৪০০ বছর পূর্বের সেই আইয়্যামে জাহিলিয়াতের তমাচ্ছন্ন ঘোর অন্ধকার থেকে উত্তরণের নাম। এই সংজ্ঞা মতে, ধর্মনিরপেক্ষতাকে উপেক্ষা করে ধর্মীয় অনুশাসনের মাধ্যমে যাবতীয় সংকীর্ণতা পিছনে ফেলে হযরত মুহাম্মাদ (ছা:) এর প্রদর্শিত আদর্শর অগ্রগতিকেই প্রগতি বলে, যা চিরন্তন ও সার্বজনীন। আদি পিতা হযরত আদম (আ:) দ্বীন ইসলামের প্রথম বাহক। যুগে যুগে প্রয়োজন বোধে মহান আল্লাহ্ দ্বীন ইসলামকে প্রগতিশীল করার উদ্দেশ্যে মানব জাতির মধ্য থেকে নবী-রাসূল নির্বাচিত করে দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন। সর্বশেষ হযরত মুহাম্মাদ (ছা:) এর মাধ্যমে প্রগতির চিরন্তন ও সার্বজনীন ভিত্তি স্থাপন করেছেন। যা শাশ্বত অপরিবর্তীত। আর ইসলামের অনুশীলনের মাধ্যমে রাসূল (ছা:) অন্ধকারাচ্ছন্ন জাহেলী যুগকে প্রগতিশীল স্বর্ণযুগে পরিণত করেছিলেন। সেই যুগের মানুষই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। তারা ইসলামের বিধিবিধান অনুসরণ করেই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিলেন। এসম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ﻛُﻨْﺘُﻢْ ﺧَﻴْﺮَ ﺃُﻣَّﺔٍ ﺃُﺧْﺮِﺟَﺖْ ﻟِﻠﻨَّﺎﺱِ – ‘তোমরাই হ’লে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে’ (আলে ইমরান ৩/১১০)। নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, ﺧَﻴْﺮُ ﺍﻟﻨَّﺎﺱِ ﻗَﺮْﻧِﻲْ ﺛُﻢَّ ﺍﻟَّﺬِﻳْﻦَ ﻳَﻠُﻮْﻧَﻬُﻢْ ﺛُﻢَّ ﺍﻟَّﺬِﻳْﻦَ ﻳَﻠُﻮْﻧَﻬُﻢْ- ‘আমার যুগের মানুষই সর্বোত্তম মানুষ। অতঃপর তার পরের যুগের মানুষ, অতঃপর তার পরের যুগের মানুষ’। (বুখারী, হা/২৬৫২; মুসলিম, হা/২৫৩৩)।
তাছাড়া তখন যেসকল দেশে ইসলামী আইনের অনুশাসন বিদ্যমান ছিল ঐ সকল দেশ প্রগতীর মাধ্যমে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিল। এখনো যেসব দেশে ইসলামের অনুশাসন যত বেশী সেই সব দেশ তত উন্নত, সভ্য ও প্রগতির উচ্চ শিখরে অবস্থান করছে। যদি আমরা ইসলামী অনুশাসনের আদলে ইসলামী প্রগতিশীল হয় তবে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত নাযিল করা হবে এবং প্রবৃদ্ধিতে দেশকে সমৃদ্ধ করা হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ﻭَﻟَﻮْ ﺃَﻥَّ ﺃَﻫْﻞَ ﺍﻟْﻘُﺮَﻯ ﺁﻣَﻨُﻮﺍ ﻭَﺍﺗَّﻘَﻮْﺍ ﻟَﻔَﺘَﺤْﻨَﺎ ﻋَﻠَﻴْﻬِﻢْ ﺑَﺮَﻛَﺎﺕٍ ﻣِﻦَ ﺍﻟﺴَّﻤَﺎﺀِ ﻭَﺍﻟْﺄَﺭْﺽِ ﻭَﻟَﻜِﻦْ ﻛَﺬَّﺑُﻮﺍ ﻓَﺄَﺧَﺬْﻧَﺎﻫُﻢْ ﺑِﻤَﺎ ﻛَﺎﻧُﻮﺍ ﻳَﻜْﺴِﺒُﻮﻥَ ‘জনপদের অধিবাসীরা যদি ঈমান আনয়ন করে এবং আল্লাহভীতি অর্জন করে, তবে তাদের প্রতি আসমান-যমীনের যাবতীয় বরকতের পথ উন্মুক্ত করে দিব’ (আ‘রাফ ৯৬)।
আমাদের সমাজে এক শ্রেণির কিছু মানুষ আছে যারা ইসলামকে চিরন্তন প্রগতিশীল মনে করেন, তবে ইসলামের যোজন-বিয়োজনের প্রয়োজনও অনুভব করেন। আর তা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের ভুল অর্থ ও অপব্যাখ্যার মাধ্যমে কিয়াস করে থাকেন। আবার তারা বিজাতীয় মতবাদবে সরাসরি গ্রহণ না করে ঘুরিয়ে তা গ্রহণ করেন। তাদের মতে যুগের সাথে বা সামাজিকতার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। অথচ দ্বীন ইসলামকে মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য মনোনীত করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ﺇِﻥَّ ﺍﻟﺪِّﻳْﻦَ ﻋِﻨْﺪَ ﺍﻟﻠﻪِ ﺍﻟْﺈِﺳْﻼَﻡُ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্র নিকট মনোনীত দ্বীন হচ্ছে ইসলাম’ (আলে-ইমরান ৩/১৯)। আর এই দ্বীনের মধ্যে কোন প্রকার রদ বদল বা যোজন-বিয়োজন করা প্রশ্নই আসে না। দ্বীন ইসলাম চিরস্থায়ী পূর্ণাঙ্গ ও সংযোজন-বিয়োজন মুক্ত সার্বজনীন প্রগতিশীল। এসম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ﺍَﻟْﻴَﻮْﻡَ ﺃَﻛْﻤَﻠْﺖُ ﻟَﻜُﻢْ ﺩِﻳْﻨَﻜُﻢْ ﻭَﺃَﺗْﻤَﻤْﺖُ ﻋَﻠَﻴْﻜُﻢْ ﻧِﻌْﻤَﺘِﻲْ ﻭَﺭَﺿِﻴْﺖُ ﻟَﻜُﻢُ ﺍﻟْﺈِﺳْﻼَﻡَ ﺩِﻳْﻨًﺎ – ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার নে‘মত পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম’ (মায়েদাহ ৫/৩)।

Leave a comment